সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবকে হঠাৎ চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। পত্র-পত্রিকার খবরে জানা যায়, তিনি একটি মিটিংয়ে ছিলেন। এমন সময় তাঁর কাছে ওই চিঠি দিয়ে বলা হয়, ‘আপনি আর দায়িত্বে নেই!’ কোনো কোনো পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কাজের জন্য তাঁকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। যদিও ঠিক কোন অপরাধে তাঁকে এ শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি পরিষ্কার করা হয়নি। এ ঘটনার পর সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি ক্লাস নাইন থেকে ছাত্রলীগ করতাম।’ এ কথা বলে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, সেটিও পরিষ্কার নয়। তিনি কী বোঝাতে চাইছেন, ছাত্রলীগ করার পরও কেন তাঁকে এ শাস্তি দেওয়া হলো? নাকি ছাত্রলীগ করলে অন্যায় করেও রেহাই পাওয়া যায়?
এত গুরুত্বপূর্ণ একজন সরকারি কর্মকর্তাকে এভাবে হঠাৎ অবসরে পাঠানোতে দেশের জনগণের মনে যেমন নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, ঠিক তেমনি এটাও অনুমান করা যায়, হয়তো সচিবালয়ের অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও একধরনের অস্বস্তি তৈরি হতে পারে। সরকারের উচিত ছিল পরিষ্কার করে বলা, কেন এই সচিবকে হঠাৎ অবসরে পাঠানো হলো। এটি না করা হলে এ নিয়ে জনমনে বোধ করি আরও বেশি সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে। তিনি যদি কোনো অপরাধ করেই থাকেন, কেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত কমিটি করা হলো না? কেন তাঁকে কোনো কঠিন শাস্তির আওতায় না এনে স্রেফ অবসরে পাঠানো হলো? সরকারকে তো এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে হবে। দেশের জনগণের অধিকার আছে বিষয়গুলো জানার। তাঁদের ট্যাক্সের টাকাতেই কিন্তু এই আমলাদের বেতন দেওয়া হয়।
দেশের মানুষ ভাবছে, আপনারা স্রেফ সাধারণ মানুষকে খরচ কমাতে বলছেন। তারা ভাবছে বিদ্যুৎ সমস্যা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যদ্রব্য বেশি দামে কেনা—এসব বোধ করি কেবল সাধারণ মানুষের জন্য। দেশের কর্তাব্যক্তিদের জন্য তো এই সময়ে এসেও কোটি টাকার বাড়ি বানানো যাচ্ছে!
ট্যাক্সের টাকার কথা যখন এলই, তখন আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। এক খবরে জানা গেছে, মুখ্য সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের জন্য সরকার বাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এসব বাড়ি বানাতে কোটি কোটি টাকা খরচ হবে। সচিবদের জন্য যদি সত্যিই বাড়ির প্রয়োজন হয়, তাহলে বানাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে বছরখানেক ধরে পুরো পৃথিবীজুড়েই অর্থনৈতিক সমস্যা চলছে। যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলছেন সামনে ‘দুর্ভিক্ষের’ পরিস্থিতিও হতে পারে। সবাইকে তিনি খরচ কমাতে বলেছেন। সেখানে এই সময়ে এসে কেন এমন একটা ঘোষণা দেওয়া হলো? কোটি টাকার বাড়ি বানিয়ে বুঝি আপনারা দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সামাল দেবেন?
মানুষ তিন বেলা খাবার খেতে হিমশিম খাচ্ছে। ঠিকমতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। প্রতিদিন সরকারকে বলতে হচ্ছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এমন হচ্ছে। সেই দেশে এমন পরিস্থিতিতে কেন কোটি টাকা খরচ করে সচিবদের জন্য বাড়ি করতে হবে এখন? এ প্রজেক্ট যদি আরও আগেও হাতে নেওয়া হয়; কেন বর্তমান পরিস্থিতে সেটা বাতিল করা হলো না? তাহলে আপনারা নিজেরা খরচ কীভাবে কমাচ্ছেন? দেশের মানুষের কাছে তাহলে বার্তাটা কী যাচ্ছে?
দেশের মানুষ ভাবছে, আপনারা স্রেফ সাধারণ মানুষকে খরচ কমাতে বলছেন। তারা ভাবছে বিদ্যুৎ সমস্যা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যদ্রব্য বেশি দামে কেনা—এসব বোধ করি কেবল সাধারণ মানুষের জন্য। দেশের কর্তাব্যক্তিদের জন্য তো এই সময়ে এসেও কোটি টাকার বাড়ি বানানো যাচ্ছে! মানুষের কাছে যদি আপনারা নিজেরা স্বচ্ছ না থাকেন, তাহলে ভবিষ্যতে যখন এর চেয়েও জটিল কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে; তখন হয়তো সাধারণ মানুষ আর আপনাদের কথা শুনবে না। তখন তারা ভাববে, সব সমস্যা কেন তাদের ওপর দিয়েই যাবে। কর্তাব্যক্তিরা তো দিব্যি ভালো আছে কোটি টাকার বাড়িতে থেকে।
স্বচ্ছতার দরকার আছে সব বিষয়ে। সে হোক কেন একজন সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো কিংবা কেন সচিবদের জন্য এ মুহূর্তে কোটি টাকার বাড়ি বানাতে হচ্ছে। অথবা কেন একজন সচিব বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর বলছেন, ‘আমি ক্লাস নাইন থেকেই ছাত্রলীগ করতাম!’
ড. আমিনুল ইসলাম সিনিয়র লেকচারার, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ এস্তনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি।
ই-মেইল: [email protected]