দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা বলেছেন। এই লেখা যখন লিখছি, তখন রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে সেনাপ্রধানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা করার কথা।
ধরে নিচ্ছি, এটা সামরিক অভ্যুত্থান নয়। দেশের একটা সন্ধিক্ষণে, বিশেষত শত শত প্রাণহানি, হাজারো মানুষ আহত হওয়া, হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক সরকার বদলের পালা এটা নয়। জাতির এই সন্ধিক্ষণে সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে; কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দাঁড়ি, কমা মিলিয়ে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই এটা হয়তো করা সম্ভব না–ও হতে পারে। তার অর্থ এই নয়, সংবিধান উপেক্ষা করে নতুন সরকার গঠন করতে হবে।
দেশের এই সন্ধিক্ষণে এবং বিশেষ প্রেক্ষাপটের কারণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এর মধ্যে একনায়কতন্ত্র সরকারের জাঁতাকলে বছরের পর বছর ধরে নিষ্পেষিত জনগণের আকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে, যেই সরকার নিকট অতীতের অন্যায়, জুলুম, হত্যা, দুর্নীতি, ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ, অপব্যবহার ইত্যাদির সম্পূর্ণ বিচার না হলেও এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনবে।
সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখন যে বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো আমাদের একটা সংসদ বহাল আছে। সংসদ বিলুপ্ত করা হয়নি, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। যদিও এই মুহূর্তে সন্দেহ জাগাটা স্বাভাবিক, বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে সংসদে কতজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে!
যাহোক, একটি সংসদ আছে এবং রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানে ক্ষমতা দেওয়া আছে যে প্রধানমন্ত্রী যদি পদত্যাগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী যদি রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দিতে বলেন, তাহলেও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সেই উপদেশ মানতে বাধ্য নন।
সংবিধানে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে সংসদে অন্য কোনো ব্যক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পাবেন, তাহলে সংসদ ভেঙে না দিয়ে অনুরূপ ব্যক্তিকে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ পড়াতে পারেন।
সংবিধানের এই বিধানের আলোকে বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মোটামুটি নিরপেক্ষ, সৎ ও দেশের জাতীয় কল্যাণের চিন্তা যাঁর মাথায় প্রধান এবং নিজের ক্ষমতা, স্বার্থ ও লোভলালসা যাঁর কম, সে রকম একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি আপাতত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নিয়োগ করতে পারেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে, বিগত বছরগুলোর জঞ্জাল দূর করা। সেই সঙ্গে বর্তমান সংসদের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা। যাঁদের দলীয় আনুগত্যের কালো অধ্যায় অতটা প্রকট ছিল না এবং যাঁরা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না, এ রকম ব্যক্তিদের নিয়ে ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে, বিগত বছরগুলোর জঞ্জাল দূর করা। সেই সঙ্গে বর্তমান সংসদের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা। যাঁদের দলীয় আনুগত্যের কালো অধ্যায় অতটা প্রকট ছিল না এবং যাঁরা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না, এ রকম ব্যক্তিদের নিয়ে ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে।
সেই সঙ্গে অবশ্যই সংবিধানে যে এক-দশমাংশ মন্ত্রী বাইরে থেকে নিয়োগ করা যায়, সেই বিধানও প্রয়োগ করতে হবে। সেই বিধান প্রয়োগ করে মন্ত্রিসভায় একজন-দুজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
সেই সঙ্গে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণযোগ্য, দলনিরপেক্ষ ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে হবে। যাঁরা প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের উপদেশ দিতে পারেন। তাঁদের সেই উপদেশের গুরত্বটা অনেক বেশি থাকতে হবে। তাহলে একদিকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাও থাকবে; অন্যদিকে দলনিরপেক্ষ, শ্রদ্ধাভাজন ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে।
বর্তমান সংসদের মেয়াদ মাত্র কয়েক মাস পেরিয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচনের অনেক দেরি। অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি কর্মপরিকল্পনা করে যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন দিতে হবে। এর মধ্যে দেশে যে অত্যাচার, অনাচার, দুর্নীতি হয়েছে তার বিচার করতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক—এসব জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে।
ন্যায়পাল নিয়োগ করাসহ আনুষঙ্গিক যেসব সংস্কার দরকার, সেগুলোতে হাত দিতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়া, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হওয়ার পরে ও প্রয়োজনীয় আইন করে অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা একটি নতুন যাত্রা শুরু করতে পারব।
রাষ্ট্রকাঠামোর পুঞ্জীভূত জঞ্জাল এক দিনে সরানো যাবে না। রাতারাতি সেই চেষ্টা করাটাও শুভবুদ্ধির লক্ষণ হবে না। তবে এই জঞ্জাল সরানোর জন্য এবং ভবিষ্যতে যাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা না যায়, জবাবদিহি নিশ্চিত থাকে, সে জন্য সংবিধানে কিছু সংশোধনী অবশ্যই করতে হবে। তবে সেটি করতে হবে ভেবেচিন্তে।
সবশেষে সেনাপ্রধান তাঁর বক্তব্যে জনগণকে শান্ত থাকার, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ গোলযোগ থেকে বিরত থাকার যে আহ্বান জানিয়েছেন, আমার মনে হয়, বিজয়ী জনতা সেই আহ্বান সাদরে গ্রহণ করবে। ছাত্র-জনতার অবদান আমাদের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।
ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী