আমি যে শহরে থাকি, সেখানে সবাই বোকা। যতটুকু জানি, একমাত্র বোকাদের ভালো-মন্দ বোধের ক্ষমতা কম থাকে। কথায় আছে, নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমরা পাগলের চেয়েও অধিকতর বোকা। অনেক বিষয় আছে আমরা বুঝেও বুঝি না। মোদ্দাকথা, আমাদের স্বভাব এমন যে পেছন দিয়ে কুঠার গেলেও কর্ণপাত নেই, অথচ সামনে দিয়ে সুচ যেতেই বাধা।
কে না জানে? পলিথিন, মাদক সেবন, পোনা মাছ নিধন, খাদ্যে ভেজাল, জীবিকার সন্ধান, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট নিয়ে নিয়মিত প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে কি? না, হচ্ছে না; বরং তীব্রতা বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। এ যেন হিতে বিপরীত কাণ্ড। সুতরাং নিঃসন্দেহে আমরাও বোকাদের দলে। কেননা, বোকাদের মতো স্বভাব-আচরণে আমরা অতিশয় অভ্যস্ত। দেখে নেওয়া যাক, বোকার শহরে বোকাদের কর্মকাণ্ড ও ক্ষতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
পলিথিন: আমরা ভুলে যাই পলিথিনের ক্ষতিকর দিক অত্যন্ত ভয়াবহ। বহনযোগ্য সামান্যতম সুবিধার জন্য চিরস্থায়ী অসুবিধা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে আমাদেরই লাভ। ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা সব সময় প্রকৃতিনির্ভর। প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে আমরাও বড় রকমের ক্ষতির শিকার হব। ফলে জীবনযাত্রার মান স্বাভাবিকভাবেই অগোছালো বা অন্য রকম হয়ে যাবে। অবহেলার এই চরম ভুলের খেসারত ভবিষ্যতে আমাদেরই পোহাতে হবে। পলিথিন ব্যবহার রোধ করতেই হবে, পলিথিনের বিকল্পও সহজলভ্য করতে হবে।
মাদক সেবন: চিকিৎসাবিদ্যায় মাদকাসক্তিকে বলা হয় ক্রনিক রিলাক্সিং ব্রেন ডিজিজ। অবাক করার বিষয় হচ্ছে একবার কেউ মাদকে আসক্ত হয়ে গেলে, তাদের মস্তিষ্ক মাদকের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অর্থাৎ মাদক হয়ে যায় মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণকারী। মাদকদ্রব্য সেবনে একজন ব্যক্তি নিজে যেমন তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে, একই সঙ্গে তারা অসহায় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে পরিবারের সদস্যদের জীবন।
পোনা মাছ নিধন: একটি চরম বোকামির গল্প সদ্য পোনা মাছ নিধন। কেননা, একটা পোনা মাছ থেকে একটা বড় মাছ পাওয়া যায়। অর্থাৎ পুষ্টি, পরিমাণ ও মূল্য বিবেচনায় লক্ষাধিক পোনার সমান কয়েকটি বড় মাছ। লাখ লাখ পোনা ধ্বংস করে হয়তো এক বেলার আহার রোজগার হবে, কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করলেই ওই পোনা মাছে লাখ লাখ বড় মাছের সাক্ষাৎ মিলবে, যা দিয়ে এক বছরের খাবার মিলবে। তবে অতি পুষ্টির জন্য ছোট জাতের মলা-ঢেলার মতো পোনা মাছ কুড়ানো দোষ নেই।
খাদ্যে ভেজাল: খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব জেনেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যের ভেতর ফরমালিন নামে বিষের সংমিশ্রণ আনেন। বিষ মেশানো খাদ্যে হয়তো একটু বেশি লাভবান হওয়া যায়, কিন্তু এই অর্থ দিয়ে যদি আমিও বিষ কিনে খাই, তবে কী লাভ হলো?
জীবিকার অনুসন্ধান: উচ্চশিক্ষা অর্জন মানেই কি সরকারি চাকরি? ব্যাংকার? অনেক টাকার মালিক? না। এগুলো হচ্ছে মোহ। এই মোহ জীবনের কাঁটা। বেঁচে থাকার জন্য সৎকর্ম যথেষ্ট। মানুষ বেঁচে থাকে স্বপ্ন ও সম্মানে। দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট করেই যদি ক্ষমতা নেওয়া লাগল, জীবনের সাধ এল কোথায়? সুতরাং যোগ্যতা অনুযায়ী যেকোনো পেশাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই জীবনের তৃপ্তি। একটা পথে কাঁটা দেওয়া থাকলে, অন্য পথ খুঁজে নিতে হবে। চাকরির হাজার পথ খোলা থাকে। শুধু সরকারি চাকরির পেছনে বয়স শেষ করলে চলবে না।
এই চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে পরিবার, বিবাহ, সমাজ সবকিছুই অপেক্ষা করে মানুষ। আমি যদি চেষ্টা করতে করতে ৪০ পার করে দিলাম, তবে পরিবারের হাল ধরবে কে? বৃদ্ধ মা–বাবার কী হবে? শুধু কি চাকরিই জীবনের সবকিছু? চাকরি পেতে যদি মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়, কি লাভ?
সুতরাং সবকিছু খুঁটিয়ে দেখা হলে বোঝা যায় আমরা সবাই বোকা। আমরা যদি খামখেয়ালি অনিয়মের এই অভ্যাসগুলো ঢেলে ফেলে দিয়ে নতুনভাবে চলতে না শিখি, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য চরম ভোগান্তি অপেক্ষা করবে। অর্থাৎ এই বোকার শহরে বড় বড় অট্টালিকা থাকতেও এগুলো নিজের স্বার্থে নির্মিত। ফিরে আসা হোক নতুন শহরে, যেখানে সবাই একজন। অর্থাৎ সবার চিন্তাধারা একই। সবার ভাবনা সবাইকে নিয়ে। সবার চিন্তা প্রকৃতি আর জীবনকে নিয়ে। তবেই আমরা হতে পারব বুদ্ধিমান এবং বুদ্ধিমান শহরের মানুষ।
এস এম জসিম
শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।