আমেরিকার নির্বাচনে মুসলিম ভোট কোন পক্ষে যাবে

তরুণ আমেরিকান মুসলিমরা ২০১৬ সালে কানসাসে প্রার্থী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছেন।ছবি: রয়টার্স

মার্কিন নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, সংবাদমাধ্যমে একটি প্রশ্ন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে, মুসলিম আমেরিকানরা এবারের নির্বাচনে কোন পক্ষ নেবেন? মুসলমানরা মার্কিন জনসংখ্যার এক শতাংশ। সংখ্যার বিচারে খুব বেশি নয়। কিন্তু মিশিগান ও পেনসিলভেনিয়ার মতো তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজ্যগুলোর জন্য মুসলিম ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। আর এই বছরের মুসলিম ভোটের ক্ষেত্রে একটাই ইস্যু—গাজা।

গাজার নির্মম ভয়ংকর যুদ্ধে বাইডেন-কমলা প্রশাসনের ভূমিকায় আমেরিকান মুসলমানরা হতাশ। আর ফিলিস্তিনিদের অমানবিক দুর্দশার জন্য ডেমোক্র্যাটদের প্রতি আছে তাঁদের ঘৃণা। তাঁরা ভোলেননি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিমদের ওপর নিষেধাজ্ঞা। ভোলার কথা নয় যে কীভাবে ৯/১১ পরবর্তী সময়ে রিপাবলিকানরা ইসলামফোবিয়া অব্যাহত রেখেছেন। আমেরিকান মুসলিমরা এবার তাহলে কী করবেন? তাঁরা কি দুই শয়তানের মধ্যে কম খারাপটাকেই বেছে নেবেন? নাকি এই ভোট থেকে নিজেদের সরিয়ে নেবেন?

নির্বাচনী জরিপ বলছে যে প্রায় ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন। এই খবর ডেমোক্র্যাটদের জন্য খারাপ। আমেরিকান মুসলিমদের মধ্যে ২০১৬ সালে ৬৫ শতাংশ হিলারি ক্লিনটনকে এবং ২০২০ সালে ৮০ শতাংশ জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছিলেন। বারাক ওবামার ক্ষেত্রে এই অনুপাত ছিল ২০০৮ সালে ৮০ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ৯২ শতাংশ।

কমলা হ্যারিসকে প্রত্যাখ্যানকারী মুসলিম আমেরিকানরা ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারেন। বেছে নিতে পারেন তৃতীয় কোনো প্রার্থীকে অথবা ভোট দেওয়া থেকে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মুসলিম আমেরিকানদের এই প্রবণতা যেকোনো দেশের উদার প্রগতিশীলদের জন্য কিছু ভাবনার বিষয় উপহার দিতে পারে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যত বেশি পরিমাণে পঙ্গু করে দেওয়া হয়, গণতন্ত্রমনা মানুষ রাজনীতিতে তত কম জড়িত হন। এমন পঙ্গু একপেশে রাষ্ট্রব্যবস্থায় যাঁরা জড়িত হন, তাঁদের তাঁরা অবক্ষয়ের পক্ষের লোক বলে মনে করেন। কিন্তু নির্বাচন ত্যাগ করা গণতন্ত্রকে অন্যের হাতে সঁপে দেওয়ার সমান।

মুসলিম আমেরিকানরা মনে করেন যে নির্বাচন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে ফেলা গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যানের শামিল। এমন পরিস্থিতিতে কোনো উদার গণতন্ত্রমনা মানুষ কী করবেন? আমেরিকান মুসলিমদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে শেখার আছে।

তৃতীয় বিশ্বে আমরা কিছু ব্যক্তিকে ত্রাণকর্তা বানিয়ে তাঁদের সামনে রেখে সমাবেশ করি। আমাদের রাজনীতি আবেগের, সংগঠনের নয়।

মুসলিম আমেরিকানরা তাঁদের ভোটের শক্তিকে সম্মান করেন। তাঁরা কমলা আর ট্রাম্প—উভয় পক্ষের নীতি বিশদভাবে বোঝেন। ঠিকমতো জেনেবুঝেই তাঁরা ভোট দেন।

উইজডম অব ক্রাউডস নামে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রশ্ন নিয়ে কাজ করা একটি বিতর্ক মঞ্চ আছে। তারা শাদি হামিদ ও হারুন মোগলের মধ্যে একটি বিতর্ক আয়োজন করেছিল। বিতর্কে বোঝা গেছে যে মুসলিম আমেরিকান নির্বাচনী মতামত বিভক্ত।

হামিদ গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতাকে সমর্থন করার দায়ে ডেমোক্র্যাটদের শাস্তি পাওয়ার তাগিদকে দমিয়ে দেওয়ার পক্ষে। তিনি কমলা হ্যারিসকে ভোট দেওয়ার তদবির করেন। তাঁর মতে, ট্রাম্পের বিজয়ের ফলে মার্কিন গণতন্ত্রের যে সামগ্রিক ক্ষতি হবে, তা সামলানোর এই একটাই উপায়। তিনি বিশ্বাস করেন যে কমলা হ্যারিস প্রশাসনে প্যালেস্টাইনপন্থী কণ্ঠস্বর স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে হারুন মোগল নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার পক্ষপাতী। কারণ, যারা যুদ্ধাপরাধে সহায়তা করেছে, এমন একটি দলকে বিবেকবান কেউ সমর্থন করতে পারেন না।

এই ভাষ্যকাররা পরিস্থিতি নিয়ে একমত নন, কিন্তু তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা এবং মার্কিন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তাঁদের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।

কিন্তু পাকিস্তানের মতো দেশে যাঁরা জনজীবন থেকে সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহার করতে চান, তাঁরা একেকজন একেক মেরুতে অবস্থান করেন। একে অপরকে সমালোচনা করতে তাঁদের উৎসাহ লক্ষ করার মতো। অথচ গঠনমূলক বিতর্ক এবং পারস্পরিক সহযোগিতা থেকে তাঁরা উপকৃতই হবেন।

ডেমোক্রেটিক পার্টি নিয়ে মোগল যে সমালোচনা করেন, তা মূলত নীতির ভিত্তিতে; অর্থাৎ যে দলটি গণতন্ত্রের নিয়ম মানছে না, তাকে সমালোচনা করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে আমেরিকা ক্রমেই বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে। আমেরিকানরা এর পক্ষে ভোট দেননি। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন। কয়েক বছর ধরে ডেমোক্র্যাট নীতিনির্ধারকেরা নাগরিকদের মতামত উপেক্ষা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৭৭ শতাংশ নাগরিক ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানোর বিরোধিতা করেন। অথচ ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ হয়নি।

মোগল প্রেসিডেন্ট পদে কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবেন না। তবে স্থানীয় ও রাজ্যস্তরের প্রার্থীদের সমর্থন করবেন। তিনি দলীয় নেতাদের প্রত্যাখ্যান করছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নয়। যেসব দেশে অভিজাতরা রাষ্ট্রকে দখল করে রেখেছে, সেখানে সবচেয়ে ভালো পাল্টা জবাব হচ্ছে স্থানীয় সরকারকে পুনরুজ্জীবিত করা। গণতন্ত্রপন্থীদের এটাই হওয়া উচিত মূল অগ্রাধিকার।

আমেরিকান মুসলিমরা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ওপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু ইসরায়েলপন্থী অবস্থানের যে আমেরিকান নীতি তার বিপরীতে, ফিলিস্তিনের পক্ষে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ, তাঁরা জনগণের সামনে হাজির করতে পারেননি। যদিও আমেরিকান মুসলমানদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছে। কিথ এলিসন ২০০৬ সালে প্রথম মুসলিম কংগ্রেসম্যান হয়েছেন। ২০১৬ সালে সোমালীয় শরণার্থী ইলহান ওমর এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের ফিলিস্তিনি রাশিদা তালিব জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।

তৃতীয় বিশ্বে আমরা কিছু ব্যক্তিকে ত্রাণকর্তা বানিয়ে তাঁদের সামনে রেখে সমাবেশ করি। আমাদের রাজনীতি আবেগের, সংগঠনের নয়।

এমন হওয়ার কারণও আছে। শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে আমরা প্রশিক্ষিত নই। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই আমাদের মূল বিষয়গুলোতে ফিরে যাওয়া উচিত; অর্থাৎ স্কুলে নাগরিকদের কর্তব্য ও অধিকার শেখানো এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রসংঠনগুলোকে শক্তিশালী করা। ব্যবস্থাকে যদি ভালোভাবে কার্যকরভাবে চালাতে চান, তাহলে তা নিচ থেকেই কার্যকর করতে হবে। মার্কিন নির্বাচনে যিনিই জিতুন, মুসলিম আমেরিকানদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখা উচিত।

  • হুমা ইউসুফ রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন