অভিমত
বাংলাদেশ, তুমি কার
সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, অবহেলা বা ব্যর্থতা বিষয়ে প্রশ্ন কে তুলবে? সাধারণ মানুষের এ ব্যাপারে কিছু করার ক্ষমতা নেই। তারা যদি কোথায় কী হচ্ছে তা না জানে, তাহলে সে ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবেই-বা কীভাবে?
সম্প্রতি একটি নতুন শব্দ-ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি—গ্যাংস্টার ডেমোক্রেসি। বাংলায় বলতে পারি দুর্বৃত্ত গণতন্ত্র। রাশিয়ার চলতি হাল বোঝাতে এ কথার ব্যবহার হয়েছে। কাগজে-কলমে রাশিয়া একটি গণতান্ত্রিক দেশ, সেখানে নিয়মিত নির্বাচন হয়। মোটামুটি মুক্ত নির্বাচনই বলব।
কিন্তু দেশটির আসল মালিক অতি ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী, যাদের পোশাকি নাম অলিগার্ক। ক্ষমতায় টিকে থাকতে এরা হেন কাজ নেই করে না। বিপক্ষে কথা বললে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে জেল। ট্যাঁ-ফুঁ করলে ৪২ তলা থেকে টুপ করে ফেলে দেওয়া! হুমকি মনে হয়, এমন লোককে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা।
রাশিয়ার ‘গ্যাংস্টার ডেমোক্রেসি’
এ কাজ অন্য প্রায় সব গোষ্ঠীপতিই করে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে সিরিয়া বা ভেনেজুয়েলার কথা ভাবতে পারেন। তবে রাশিয়া এই গ্যাংস্টার ডেমোক্রেসিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে তাকে ইউনিক বা ব্যতিক্রমী বলা ছাড়া উপায় নেই। সে কাজ হলো রাষ্ট্রের টাঁকশাল উজাড় করে সত্যিকারের গ্যাংস্টার পোষা। এই গ্যাংস্টারদেরই একজন ইয়েভগেনি প্রিগোশিন।
তিন সপ্তাহ আগে তিনি হঠাৎ রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে মস্কো দখলে রওনা হন। ২৪ ঘণ্টা না যেতেই তাঁর বিদ্রোহ শেষ। মজার ব্যাপার হলো এমন ভয়াবহ অপরাধের জন্য তাঁকে কোনো শাস্তি দেওয়া তো হলোই না, উল্টো জামাই আদরে তাঁকে বিদেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। সপ্তাহ না যেতেই জানা গেল, তিনি বিদেশে না গিয়ে মস্কো ফিরে এসেছেন এবং স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছেন।
পত্রিকায় পড়ে জেনেছি, সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বিষয়টি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় সে চিঠি পড়ার সময় করে উঠতে পারেননি। সেটা জানুয়ারি মাসের কথা। আশাকরি, এত দিনে তিনি চিঠিটি পড়ার সময় করে নিয়েছেন। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, ব্যাপারটা এক-দুই টাকার নয়, প্রায় ৬০০ কোটি টাকার।
এত দিন আমরা জেনেছি, লোকটি ভাগনার নামে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির মালিক, যার কাজ বিদেশে ভাড়াটে সেনা খাটানো। কিন্তু এখন জানছি, না, এটি আসলে ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়, ক্রেমলিনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এর কাজকর্ম চলে। খাইখরচ, তা-ও আসে ক্রেমলিন থেকে। এই ভাগনার কোম্পানি সিরিয়ায় ও আফ্রিকার একাধিক দেশে ভাড়াটে সৈন্য খাটিয়ে তাদের নিষ্ঠুরতার জন্য নাম কিনেছে।
এ কাজে তারা এতটাই সফল যে মালির সামরিক সরকার সেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী হটিয়ে এদের হাতে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ভার ছেড়ে দিয়েছে। ভাড়ায় সৈন্য খাটানো ছাড়া আরও একটা কাজে প্রিগোশিন ও তাঁর কোম্পানি বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে, আর তা হলো বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে নাক গলানো।
প্রিগোশিন নিজেই স্বীকার করেছেন, ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি—এ রকম নিরীহ নামের যে কোম্পানি তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে পরিচালনা করেন, তার আসল কাজ যুক্তরাষ্ট্র বা বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে নির্বাচনী প্রচারণায় নাক গলানো। অনেকের ধারণা, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রিগোশিনের এই রিসার্চ এজেন্সি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে বড় রকমের ভূমিকা পালন করে।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজে স্বীকার করেছেন, ভাগনারকে পুষতে তাঁর সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেছে। প্রিগোশিনের বাড়ি তল্লাশির পর সেখানে দুই ট্রাকবোঝাই প্রায় এক বিলিয়ন রুবল পাওয়া গেছে। প্রথমে বাজেয়াপ্ত করা হলেও পরে প্রিগোশিনকে সে অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
গণতন্ত্র ও সরকারের জবাবদিহি
রাশিয়ার উদাহরণে যে দুর্বৃত্ত গণতন্ত্রের কথা বলছি, তার মোদ্দা অর্থ, সরকার, যারা জনগণের নামে তাবৎ কর্ম পরিচালনা করে, তাদের কোনো দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি না থাকা। কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, সে ব্যাপারে দেশের মানুষ বিন্দুমাত্র জানে না, তাদের জানানোর কোনো প্রয়োজনও কেউ দেখে না। তাদের সম্মতি নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। একবার ভাবুন, ২০১৪ সাল থেকে ভাগনার গোপনে মানুষ মারার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, সে কাজে তাদের ব্যয় জোগাচ্ছে রাষ্ট্র। অথচ প্রিগোশিনের ব্যর্থ বিদ্রোহের আগপর্যন্ত তার বিন্দুবিসর্গও দেশের মানুষ জানত না। পুতিন নিজে যদি সে কথা মুখ ফুটে না বলতেন, কেউ হয়তো কোনো দিনই তা জানত না।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই সরকার বা সরকারের ক্ষমতাসীন মহল অনেক কিছুই করে, যা দেশের মানুষ জানে না বা তাদের জানানো হয় না। সুস্থ গণতান্ত্রিক দেশে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্য আইন পরিষদ থাকে, সংবাদপত্র থাকে, সুশীল সমাজভুক্ত সংগঠন থাকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যাপারে মার্কিন সরকার যে বছরের পর বছর মিথ্যা বলে গেছে, নিউইয়র্ক টাইমস-এ ‘পেন্টাগন পেপারস’ ছাপা না হলে হয়তো অজানাই থেকে যেত।
অথবা সার্জেন্ট জোসেফ ডার্বি যদি ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে সত্য ফাঁস না করতেন, তাহলে হয়তো কোনো দিনই ইরাকের আবু গারিব জেলখানায় কী ভয়াবহ অনাচার ঘটেছে, তা আমাদের অজানা রয়ে যেত। একদম সাম্প্রতিক সময়ে প্রো-পাবলিকা নামের একটি তথ্যানুসন্ধানী সংস্থা দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর জানিয়েছে, মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ক্লারেন্স টমাস বছরের পর বছর এক বিলিয়নিয়ার বন্ধুর কাছ থেকে মুলোটা-কলাটা আদায় করে নিয়েছেন, কাউকে কিচ্ছু বলেননি। প্রো-পাবলিকার প্রতিবেদনের পর এখন দাবি উঠেছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য একটি লিখিত আচরণবিধি প্রণয়ন করা হোক।
বাংলাদেশে কে প্রশ্ন তুলবে
বাংলাদেশের বেলায় সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, অবহেলা বা ব্যর্থতা বিষয়ে প্রশ্ন কে তুলবে? সাধারণ মানুষের এ ব্যাপারে কিছু করার ক্ষমতা নেই। তারা যদি কোথায় কী হচ্ছে তা না জানে, তাহলে সে ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবেই-বা কীভাবে? তা ছাড়া প্রশ্ন তুললেও সরকার সে ব্যাপারে জবাবদিহির প্রয়োজন দেখবে, সে কথা ভাবারই-বা কী এমন কারণ রয়েছে?
কথাগুলো বলছি; কারণ, সম্প্রতি জানা গেছে, সরকারি অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে বাংলাদেশ সরকারের একটি ওয়েবসাইট থেকে দেশের লাখ লাখ মানুষের নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা, জাতীয় পরিচিতি নম্বরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। এসবই অতীব গোপনীয় তথ্য, অপব্যবহার হলে এসব মানুষ বড় রকমের আর্থিক অথবা আইনি ঝামেলায় পড়তে পারেন। একটি বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে খবরটি জানা গেছে।
তারা এ বিষয়ে সাবধান না করলে আমরা হয়তো কখনো কিছুই জানতাম না। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, কারিগরি ত্রুটি ছিল, সে কারণে তথ্য ফাঁস হয়েছে। তাঁর নিজের বা সরকারের এ ব্যাপারে কোনো দায়দায়িত্ব আছে বা দায়িত্ব পালনে কোথাও কোনো গাফিলতি ছিল, সে কথা অবশ্য তিনি বলেননি। নির্ধারিত ওয়েবসাইটে কারিগরি ত্রুটি ছিল, এ কথা তো তাঁরা জানতেন। তা জানা সত্ত্বেও যদি সেখানে দেশের নাগরিকদের গোপনীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে, তাহলে এই অপরাধের জন্য কারও না কারও শাস্তি হওয়া উচিত।
জবাবদিহির প্রক্রিয়া
অনুমান করি, তথ্য সংরক্ষণে দুর্বলতা রয়েছে, এ কথা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কেউ না কেউ জানতেন বা এ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। কিন্তু মুখ ফুটে কোনো কথা বলেননি। এর এক কারণ হতে পারে, কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করলে তাঁদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। অথবা নিয়মভঙ্গের অভিযোগে অন্য কোনো দাপ্তরিক শাস্তি পেতে পারেন।
এই জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়ার একটা পথ হলো সতর্কীকরণের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থার প্রচলন। যুক্তরাষ্ট্রে দাপ্তরিক অনিয়ম রোধে তদন্তের জন্য ইন্সপেক্টর জেনারেল নিয়োগের বিধান রয়েছে। কেউ অনিয়মের কথা জানলে বেনামে বা নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্যপ্রমাণসহ ইন্সপেক্টর জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন, এমন ব্যক্তিকে ‘হুইসেলব্লোয়ার’ বলা হয়। অর্থাৎ তিনি বাঁশি বাজিয়ে সতর্ক করলেন, এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। এসব হুইসেলব্লোয়ারের পরিচয় গোপন রাখার বা কোনো রকম শাস্তি না দেওয়া নিশ্চিত করতে আইনানুগ ব্যবস্থাও রয়েছে।
কিন্তু শুধু ‘হুইসেলব্লোয়ার’ আইন করলেই তো হবে না, অনিয়মের কথা প্রকাশিত হলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার নিজে যেহেতু এই ব্যর্থতার কারণ, ফলে চোর ধরতে চোরের দোসরের কাছে গিয়ে কোনো ফায়দা নেই। এ দেশে, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে, এ কাজ করার দায়িত্ব আইন পরিষদের, অর্থাৎ কংগ্রেসের।
সরকারের কাজকর্মের ওপর নজরদারি করা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তারা দেশের মানুষকে সতর্ক করে দিতে পারে। প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে পারে। নিদেনপক্ষে যেটা করা অতি সহজ, তা হলো আইন পরিষদের নজরদারি কমিটির সামনে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ডেকে জবাবদিহির ব্যবস্থা।
আমাদের দেশেও এসব বিধিবিধান কমবেশি রয়েছে, কিন্তু কোনো বাস্তবায়ন নেই। এর একটা কারণ, বিষয়গুলো নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো উত্তাপ নেই। তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে আলোচনায় ধর্তব্যই নন। যতক্ষণ না দেশের সংবাদমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি বিষয়টি নিয়ে কোনো হইচই করছে, এ নিয়ে কারও কোনো শিরঃপীড়া ঘটবে না। দেশের মানুষের ক্ষমতায়ন নয়, তাকে যতটা সম্ভব ক্ষমতাহীন করে রাখাই আমাদের অনুসৃত নীতি।
লোপাট সার ও সরকারি দায়িত্বহীনতা
বাংলাদেশে হামেশাই নানা নিয়মবহির্ভূত কাজ হয়, কিন্তু তা নিয়ে তেমন কোনো শাস্তির বিধান নেই, অনিয়ম বন্ধেরও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। কিছুদিন আগে খবর বেরিয়েছিল, একজন পরিবহন ঠিকাদার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কোটি কোটি টাকার আমদানি করা সরকারি সার লোপাট করে দিয়েছেন।
কোম্পানিটির দায়িত্ব ছিল ট্রাকে করে সে সার সরকারি হেফাজতে এনে রাখা। দেড় বছর পর জানা গেল, তারা দায়িত্ব পালনের বদলে সে সার গায়েব করে দিয়েছে। যে ঠিকাদারি কোম্পানিকে সার পরিবহনে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তার মালিক সরকারদলীয় সাবেক একজন সংসদ সদস্য, সরকারের ভেতরের লোক।
এর আগেও সেই একই ঠিকাদার আমদানি করা সার লোপাট করেছিলেন। অপরাধী জেনেও সেই একই কোম্পানিকে কেন বারবার দায়িত্ব দেওয়া হয়? কোনো ব্যবস্থাই-বা নেওয়া হয় না কেন?
এর কারণ সম্ভবত এই যে ভাগ-বাঁটোয়ারা সমীকরণে ভেতরে-বাইরের কমবেশি সবাই জড়িত। তা ছাড়া টাকা যখন গৌরী সেনের, তখন তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?
পত্রিকায় পড়ে জেনেছি, সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বিষয়টি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় সে চিঠি পড়ার সময় করে উঠতে পারেননি। সেটা জানুয়ারি মাসের কথা। আশাকরি, এত দিনে তিনি চিঠিটি পড়ার সময় করে নিয়েছেন। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, ব্যাপারটা এক-দুই টাকার নয়, প্রায় ৬০০ কোটি টাকার।
দুর্বৃত্ত গণতন্ত্রের সঙ্গে এর পার্থক্য কতটা!