শুক্রবার বিকেল। সবজি কেনার প্রয়োজন পড়ায় ছিপছিপে বৃষ্টির মধ্যেও বাসার নিচে নামতে হলো। বাসা থেকে কয়েক গজ দূরে রিকশাভ্যানের ওপর সবজি বেচেন সেলিম ভাই। অন্য সময়ে তাঁর ভ্যানে হরেক রকম সবজি সাজানো থাকলেও তখন পটোল, কাঁচকলা, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গার বাইরে কোনো সবজি নেই। এক কোনায় পড়ে আছে একটা গোল বেগুন।
ভাবলাম, শুক্রবারের কারণে সব সবজি বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি জানালেন, সব সবজির দামই অনেকটা বেড়েছে। এত দামে সবজি মানুষ কম কিনছে। সে কারণে তিনি তিন-চার পদের বেশি সবজি আনছেন না। বেগুন দেখিয়ে বললেন, কেজি ১৬০ টাকায় উঠেছে। কোনো সবজিই ১০০ টাকার নিচে নেই। কাঁচামরিচের দাম উঠেছে কেজিতে ৪০০ টাকা।
গত কয়েক দিনে শুধু যে সবজির দাম এ রকম লাগামছাড়া বেড়েছে তা নয়, ডিমের দাম ডজন উঠেছে ১৭০ টাকা। এক-দুইটা বা এক হালি ডিম কিনতে প্রতি পিস লাগছে ১৫ টাকা করে। ফলে অনেকে ট্রলও করছেন, পানির দামে তাঁরা ডিম কিনছেন। গরিবের প্রোটিন বলে পরিচিত ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। এর প্রভাব মাছের বাজারে গিয়েও ধাক্কা দিচ্ছে। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই মাস হতে চলল। এ সময়ে ছয়টি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, কমেছে মাত্র দুটির।
ডিম, সবজি, ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার একটা বড় কারণ নিশ্চিতভাবেই বন্যা। বর্ষা মৌসুমের শেষ সময়টাতে এসে গত এক মাসে দেশে তিনটি বন্যা হয়েছে। ফলে বিস্তীর্ণ এলাকার আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পোলট্রি খামারিদের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু কোন সমীকরণে সপ্তাহের ব্যবধানে বেগুনের কেজি ৮০ টাকা কিংবা ডিমের ডজন ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়তে পারে?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো হাসিনা সরকারের আমলে সাধারণ মানুষের প্রধান উদ্বেগ, শঙ্কা ও ক্ষোভের কারণ ছিল বাজার ও জিনিসপত্রের দাম। বিশেষ করে ২০২০ সালে কোভিড মহামারি থেকে শুরু করে গত সাড়ে চার বছরে মানুষকে রীতিমতো যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে।
অনেক খাদ্যপণ্যের দাম একসঙ্গে বেড়ে গেলে বৃহৎ অংশের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সংকট তৈরি হয়। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ আশপাশের দেশগুলো মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষকে এখন অনেকটাই মুক্তি দিতে পেরেছে। মানুষ যেমন স্বাধীনতা চায়, তেমনি সন্তানের পাতে নিজের সাধ্যমতো খাবারটাও তুলে দিতে চায়। ফলে বাজারের দিকে নজর না দিলে দিনে দিনে সেটা মানুষের মধ্যে ক্ষোভকেই উসকে দেবে।
মূল্যস্ফীতি মানে মানুষের প্রকৃত আয় ক্রমাগত কমে যাওয়া। ফলে প্রতিনিয়ত ওষুধ, ছেলেমেয়ের প্রাইভেট টিউশন ফি, নিজেদের বেড়াতে যাওয়ার খরচ, বাজারসদাই থেকে মাছ-মাংস ছাঁটাই করে দেশের সিংহভাগ মানুষ কায়দা করে বেঁচে থাকার কসরত আয়ত্ত করেছিল। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে রিকশাচালক, পোশাকশ্রমিক, হকারসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসার পেছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল।
কিন্তু হাসিনা সরকার মানুষের এই কষ্ট কমাতে, এই দীর্ঘশ্বাস লাঘবে কোনো ব্যবস্থায় নেয়নি। বরং আজ আলুর সিন্ডিকেট, কাল ডিমের সিন্ডিকেট, পরশু চালের সিন্ডিকেট, তার পরদিন পেঁয়াজের সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ক্রমাগত ছোট হয়ে আসা পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশ যে অতিধনী উৎপাদনে বিশ্বে নাম্বার ওয়ান হয়ে উঠেছিল, তার পেছনে সিন্ডিকেটনির্ভর বাজারব্যবস্থার অবদান ছিল অনেকটা। তার ওপর সরকারপ্রধান কখনো ডিম সিদ্ধ করে ফ্রিজে রাখার, কখনো মাংসের বদলে কাঁঠাল খাওয়ার আবার কখনো পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করার পরামর্শ দিয়ে মানুষের যন্ত্রণায় নুনের ছিটা দিতে ছাড়তেন না।
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যখন ভীষণ গতিতে বাড়ছে, তখন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, সেপ্টেম্বর মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে। হাসিনা সরকারের সময় আমরা দেখেছি, মূল্যস্ফীতি, মাথাপিছু আয়—এসব বিষয় নিয়ে বিবিএস যে পরিসংখ্যান দিত, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল কমই ছিল। পরিসংখ্যান যে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি বর্ণনা নয়, বরং বাস্তবতা অনুযায়ী সরকার যাতে ব্যবস্থা নিতে পারে তার অস্ত্র—পরিসংখ্যান ব্যুরো কিংবা সরকারের আমলাতন্ত্র কবে সেটা বুঝবে?
মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে ও জিনিসপত্রের দাম কমাতে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ এখনো জোরালো নয়। গত ৫৩ বছরে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও গোষ্ঠীতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন অকেজো হয়ে পড়েছে, একইভাবে বাজারও কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে।
বাজারব্যবস্থা এতটাই অকেজো যে যেকোনো স্তরে, যে কেউই এখানে কারসাজি করতে পারে। এই ব্যবস্থায় উৎপাদক ও ভোক্তার সর্বনাশ করার সব ধরনের ফন্দি আছে। এই সিন্ডিকেটের হোতারা হরহামেশাই রাজনীতিবিদ থেকে ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন। দখল, চাঁদাবাজি, বাজার সিন্ডিকেটের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দারুণ ঐকমত্য।
ফলে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেটা পূরণ করতে বিএনপির লোকজন খুব বেশি সময় নেননি। কারসাজি ও অতিমুনাফার প্রশ্নে কারওরই অবস্থান খুব সৎ নয়। ফলে এখানে বাজার তদারকির জন্য শক্তিশালী ও কেজো ব্যবস্থা না থাকলে ব্যাপারটা দাঁড়াবে যে লাউ সেই কদু।
কেননা, ভোক্তা অধিকারের মতো বাজার তদারকির যে প্রতিষ্ঠান, তাদের কাজের পরিধির তুলনায় লোকবল এতটাই কম যে তাদের পক্ষে বাজার তদারকি করা সম্ভব নয়।
আবার খুচরো বাজারে কিছু লোকদেখানো পদক্ষেপ ছাড়া তেমন কোনো অভিযান দেখাও যায় না। ফলে বাজার তদারকি সংস্থা শক্তিশালী না করে সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। আবার এটাও সত্য যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে বাজারে নির্বিচারে অভিযান চালালে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হবে। এ ক্ষেত্রে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
আগের সরকারের আমলে আমরা দেখেছি, তারা কোনো কোনো পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে সেটার দাম নিয়ন্ত্রণের উদ্ভট চেষ্টা করে গেছে। চীন কিংবা উত্তর কোরিয়ার মতো নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনীতি যেখানে চালু আছে, সেখানেই কেবল সরকারের দিক থেকে দাম নির্ধারণ করে পণ্য বিক্রি করা সম্ভব। মুক্তবাজারে সেটা সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে সেই প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি। ডিম, মুরগির যে যৌক্তিক দাম তারা ঠিক করে দিয়েছিল, বাজারে সেই দামে তা বিক্রি হয়নি।
অনেক খাদ্যপণ্যের দাম একসঙ্গে বেড়ে গেলে বৃহৎ অংশের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার সংকট তৈরি হয়। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ আশপাশের দেশগুলো মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষকে এখন অনেকটাই মুক্তি দিতে পেরেছে। মানুষ যেমন স্বাধীনতা চায়, তেমনি সন্তানের পাতে নিজের সাধ্যমতো খাবারটাও তুলে দিতে চায়। ফলে বাজারের দিকে নজর না দিলে দিনে দিনে সেটা মানুষের মধ্যে ক্ষোভকেই উসকে দেবে।
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী