কয়েক দিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের নতুন কেন্দ্র ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স’-এর উদ্যোগে একটি সেমিনার হয়েছিল। বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক কোলাবরেশন, প্রায়োরিটি অ্যান্ড কনসার্ন’ (বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগীর পূর্ববর্তিতা এবং গুরুত্ব প্রদান)। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (সংক্ষেপে আইপিএস) বলতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যে ধারণা পেয়েছে তার, ভিত্তি হলো ২০১৩ সালের গোড়ার দিকে মূলত ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রস্তাব। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর যৌথ উদ্যোগে একটি বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা এখন বেশ বিস্তৃতি লাভ করছে।
পশ্চিমা দেশগুলো অগ্রগামী ভূমিকায় থাকলেও আইপিএসের প্রধান উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোকে এতে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। বলা হচ্ছে এর মূল লক্ষ্য হলো উন্মুক্ত প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরসহ (ইন্দো-প্যাসিফিক) অন্যান্য সাগরকে মুক্ত রাখা এবং তার ন্যায়ভিত্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। বহু ভূরাজনীতিবিদের মতে, পশ্চিমা বিশ্ব এবং এর মিত্রদেশগুলোর এ উদ্যোগের আসল উদ্দেশ্য হলো চীনকে ঠেকিয়ে রাখা। কারণ, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এখন চীনের উত্থানকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতি হুমকি মনে হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সেমিনারে আমিসহ কয়েকজন বাংলাদেশি ছাড়াও বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশ ও জাতিসংঘের কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন তিনজন। তাঁরা হলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশিদ আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজ এবং সাবেক কূটনীতিক ও বর্তমানে একটি বেসরকারি থিঙ্কট্যাংকের কর্ণধার ফারুক সোবাহান। প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
ফারুক সোবাহান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজের মূলপত্রে আইপিএস-এ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনার নানা দিক এসেছে। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হওয়ায় সেখানে উদ্বেগ প্রকাশও করা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এই জনগোষ্ঠী এবং এদের আদি বাসস্থান রাখাইন ঘিরে চীন-ভারত এবং বিশেষ করে আইপিএস ও কোয়াডের তৎপরতা যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা নিয়ে সেখানে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। আমি নিজেও একাধিক কলামে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।
প্রায় ছয় বছর ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও দৃশ্যত কোনো ফল আসেনি। শিগগির এ সমস্যার সমাধান হবে বলেও মনে হয় না। অন্তত যত দিন মিয়ানমারে সামরিক সরকার ১৯৮২-এর নাগরিকত্ব আইন বলবৎ রয়েছে, তত দিন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন অসম্ভব বলে মনে হয়। ১৮২৩ সালের আগের মূল নাগরিকত্বকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনের ভিত্তি ধরা হয়েছে। উল্লেখ্য, মিয়ানমার তথা বার্মায় তখন রাজতন্ত্র ছিল। ১৮২৬ সালে প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধে বার্মা একদা স্বাধীন রাষ্ট্র আরাকান যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর অবশ্য আরও দুটি যুদ্ধের পর ১৮৮৫ সালে কোনবাং শাসকদের পতনের মধ্য দিয়ে সমগ্র বার্মা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে যায়।
১৮২৬ সালে যখন আরাকানে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত হয়, সেই সময়কেই বর্তমান মিয়ানমার (বার্মা) বেজলাইন ধরেছে। ওই বছর থেকেই রোহিঙ্গাদের অত্যাচারের মাধ্যমে বাস্তুভিটাছাড়া করা শুরু হয়েছিল। অবশ্য ১৯৬২ সালে নে উইনের সামরিক শাসন শুরুর পর রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বাড়ানো বাড়তে থাকে এবং ২০১৭ সালে তা চরমে পৌঁছায়। বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকায় উদ্বাস্তু হিসেবে রয়েছেন। এর মধ্যে কিছুসংখ্যক ১৯৯২ সাল থেকে রয়ে গেছেন।
বর্তমান রাখাইনের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আরাকান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল, যা বার্মার কোনবাং শাসকেরা ১৭৮৫ সালে দখল করে, বিশেষত দক্ষিণ আরাকানে (রাখাইন) বার্মার সম্প্রদায়কে বসবাসের জন্য স্থানান্তরিত করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভারসাম্যে তারতম্য ঘটায়। তবু রাখাইনে স্থানীয় আরাকানি বৌদ্ধ, মুসলিম এবং উত্তরে উপজাতীয়দের মধ্যে যথাক্রমে চিন, ম্রো, খুমি, মারমা ও কুকি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে।
সব মিলিয়ে আরাকান বা রাখাইনে বর্মিদের শক্ত অবস্থান থাকলেও স্থানীয় যুদ্ধরত ‘ইনসারজেন্ট গ্রুপ’ আরাকান আর্মির (এএ) ৩০ হাজারের ওপরে সশস্ত্র যোদ্ধা আরাকানের স্বাধীনতার জন্য মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর (যার সিংহভাগ বার্মার বুড্ডিস্ট) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। তাদের ন্যূনতম দাবি স্বায়ত্তশাসন। এএ প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধাচরণ করলেও ইদানীং তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) ঘোষণা করেছে, তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। তারা বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রত্যাশী। আরাকান আর্মি যে রাখাইনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে, তার প্রমাণ হলো সামরিক সরকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে এএর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে।
উল্লেখ্য যে এএ একাই নয়, এই সংগঠনের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্যে রয়েছে কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি, (কেআইএ), কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ), চিন লিবারেশন আর্মি (সিএলএ) এবং আরাকান আর্মি। তদুপরি রয়েছে এনইউজি-সমর্থিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)। এদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম এএ। কাজেই জান্তা সরকারের পক্ষে এএকে গুরুত্বহীন মনে করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে এএ প্রথমবারের মতো ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) সঙ্গে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। কারণ, এনইউজি ঘোষণা করেছে, তারা মিয়ানমারকে ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে গড়বে এবং সেখানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ‘বার্মা অ্যাক্ট ২০২২’-এর কারণে এনইউজি এখন পুনরুজ্জীবিত। বার্মা অ্যাক্টে গণতন্ত্রের প্রসার, বিশেষ করে মিয়ানমারসহ এ অঞ্চলে গণতন্ত্রায়ণের কথা বলা হয়েছে। এনইউজি মনে করে, বার্মা অ্যাক্টের মাধ্যমে তাদের প্রয়াসকে স্বীকার করা হয়েছে। এনইউজি ১৯৮২ সালের মিয়ানমার নাগরিক আইন বাতিল করার পক্ষে। এসব কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বর্তমান জান্তা সরকারের কাছে আশা করা সম্ভব নয়।
আমি মনে করি, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিকল্প পথগুলো অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। এর মধ্যে প্রথমত বিভিন্ন রোহিঙ্গা রাজনৈতিক নেতার (যাঁদের বেশির ভাগ দেশের বাইরে আছেন) ঘোষিত একক সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনকে (এআরএনও) সংহত করে এএ এবং এনউজির সঙ্গে কাজ করার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ কার্যক্রমকে জাতিসংঘকে যুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এআরএনওকে আরাকানের ইউএলএ এবং এএর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে। তৃতীয়ত, ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মংডু, বুথিডং ও রথিডংয়ের পশ্চিমের বঙ্গোপসাগর তটসংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে যেভাবে ‘মাইয়ু ফ্রন্টিয়ার ডিস্ট্রিক্ট’ (যেটাকে রোহিঙ্গা বাসভূমি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল) গড়ে তোলা হয়েছিল, সে আদলেই ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যার আলামত দৃশ্যমান। ফলে বাংলাদেশ সরকারের সামনে কূটনীতি ছাড়া আর যে পথগুলো খোলা রয়েছে, সেগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)