প্রথম আলো কী ভুল করেছে, পাঠক হিসেবে আমার কাছে তা স্পষ্ট নয়। ফটোকার্ডটি দেখে বা পড়ে কোনো অসংগতি বা ভুল উদ্ধার করতে পারিনি। কোনো দ্ব্যর্থকতা বা সাংবাদিকতার নৈতিকতার সংকটও দেখিনি। সংবাদপত্র পড়ছি প্রায় ৪০ বছর, এ বিষয়ে বিদ্যায়তনিক শিক্ষা রয়েছে এবং পড়াই শিক্ষার্থীদের। বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে—
১. কনটেক্সট: কনটেক্সট সাংবাদিকতার অন্তঃপ্রাণ। ফটোকার্ডে যে কয়টি উপাদান যুক্ত রয়েছে, তা হলো দিনমজুর জাকির হোসেনের উক্তি, একটি শিশুর পেছনের ছবি, গোলাপ ফুল, গ্রিল, তালা, স্মৃতিসৌধ, রাস্তা, কিছু গাছগাছালি। সামগ্রিক কনটেক্সটের চমৎকার দৃশ্যায়ন।
তালা বা গোলাপ ফুল মনোযোগ কাড়েনি। মনোযোগ কেড়েছে জাকির হোসেনের উক্তি ও ফুল হাতে শিশুটির সঙ্গে সেটির ম্যাচিং ইস্যু।
স্মৃতিসৌধের সামনে ফুল হাতে শিশুটির ছবি পাঠক হিসেবে আমার কাছে ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি করে। এ ছবির ভেতর কিছুটা হাহাকার দেখি। শিশুকে দেখি এক অতৃপ্ত শিশুদের স্মারক হিসেবে। ছবিটি বেদনাবোধের জন্ম দেয়। ফটোকার্ডের এ অংশটুকু দেখে এক বিশুদ্ধ হতাশাবোধ ভেতরে কাজ করেছে।
এ হতাশা আমাকে সংক্ষুব্ধ করেনি। শিশুদের জন্য ভাবনা তাড়িত করেছে। শিশুর ছবি ব্যবহারে সাংবাদিকতার প্রচলিত মান সুরক্ষিত হয়েছে। শিশুটির নাম-ঠিকানা, পরিচয়, এমনকি স্পষ্ট ছবিও তুলে ধরা হয়নি। শিশুটি যে ফুল বিক্রেতা, সেই পরিচয় ঘটনার পরম্পরায় পরের খবরগুলো থেকে পাঠক জানতে পারে। শিশুর এ ছবি ফটোকার্ডের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ, যা একক অর্থ উৎপাদন করে।
২. উদ্ধৃতি: ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করমু। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’—আরেকটি স্বতন্ত্র বক্তব্য, যা আরেকটি বাস্তবতা উৎপাদন করে। এখানে বক্তার পরিচয় স্পষ্ট। তিনি দিনমজুর। বাড়ি সাভার। নাম জাকির হোসেন। শিশুর ছবির সঙ্গে দিনমজুর বক্তব্য মিলিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই।
জাকির হোসেনের নামের শেষে উল্লেখ করা হয়নি, তিনি শিশুশ্রমিক বা শিশু ফুল বিক্রেতা। পরিষ্কার করে লেখা দিনমজুর। তাহলে ছবি দিলাম একজনের আর উদ্ধৃতি দিলাম আরেকজনের—এমন কথা আসছে কেন? দুটি আইটেমের অর্থ উদ্ধারে সমস্যা হচ্ছে কেন। এটা তো ক্রিটিক্যাল রিডিংয়ের ইস্যু। এ উদ্ধৃতির সাধারণ অর্থ হলো বর্তমান বাজারব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার সংকট আর গূঢ় অর্থ হলো অসন্তুষ্টি। প্রথমটির সঙ্গে দ্বিতীয়টি সম্পর্কযুক্ত।
অর্থবিজ্ঞানীরা বলেন, শব্দের অর্থ সব সময় টেক্সটে থাকে না, থাকে পাঠকের মনে। সুতরাং মন যত রকম, অর্থ হয় তত রকম। সংবাদপত্র টেক্সট সরবরাহ করে, অর্থ নয়। অর্থ উদ্ধারের দায়িত্ব পাঠকের। ক্রিটিক্যাল রিডার্স গড়ে উঠছে কি না, তা-ও ভাবতে হবে। জনসম্মতি উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় মেশিনারিজ কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা-ও উপেক্ষার বিষয় নয়।
কে স্বাধীনতা বা দেশকে অস্বীকার করে? দেশ মানেই তো মা। মাকে অস্বীকারের সাধ্য কার? তাই বলে মায়ের রুগ্ণ স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলব না? বাজারব্যবস্থা নিয়ে জাকির হোসেনের যে ক্ষোভ, তা তো কারও একক কারণে নয়। এ ক্ষেত্রে কারও বেশি কারও কম দায় রয়েছে। আমরা উটপাখির মতো বালুর মধ্যে মুখ খুঁজে থাকলে কি এ সত্য হারিয়ে যাবে?
টেক্সটের ওপর অর্থ আরোপের এক বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর। তারা শব্দের নতুন অর্থ দান করে এবং অনুগতরা তা প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করে।
জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি যে অসত্য, এমন কথা কেউ বলছে না। অনেকে যা বলছে, তা হলো—এ উক্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকে খাটো করা হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, সমাজ কেবল লিখিত রূপের সমষ্টি নয়। লিখিত হলেই সবকিছু খাটো বা ছোট হয়ে যায় না। এ সমাজ মূলত কথানির্ভর। কথায় থাকে লেখার চেয়ে অধিকতর সত্য। জাকির হোসেন যেভাবে আঞ্চলিক টানে ‘দিয়াম, করমু, আমাগো, চাইলের’ ঘন টান দিলেন, তা তো এক নিগূঢ় সত্য; সহসী প্রকাশ। প্রকাশিত এ ফটোকার্ড ঘিরে আলোচনাটি একেবারে অন্য স্রোতে বইছে।
উদ্ধৃতিকে বলা হয় সংবাদের পেশি। কখনো কখনো সংবাদ জীবন ফিরে পায় উদ্ধৃতিতে এসে। এ উদ্ধৃতি সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে কোয়ালিফাই করার কারণে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
যে প্রশ্নটি তোলা হয়েছে, তা হলো ব্যবহৃত ছবির সঙ্গে বক্তার সাযুজ্যের বিষয়টি। ফুল হাতে শিশু এবং জাকির হোসেন আলাদা সত্তা, আলাদা ডাইমেনশন। দুটি আলাদা অর্থ। তবে ফ্রেম একটি।
ফটোকার্ডে যে পরিস্থিতি উঠে এসেছে, তা হজম করতে অনেকের সমস্যা হচ্ছে। খবর হজম না হলে জ্ঞান হবে না। আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট এ পার্কের ‘নিউজ অ্যাজ ফর্ম অব নলেজ’ নামে একটি বিখ্যাত আর্টিকেল রয়েছে। ফর্মটি যদি সঠিকভাবে দেখতে না পারি, তাহলে জ্ঞান হবে কোথা থেকে? সংবাদপত্রের কাজ তো ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের নজরদারি জানানো। কোনো পূর্বসংস্কার নিয়ে সাংবাদিকতা চলে না।
সাংবাদিকতায় প্রশ্নের বাইরে কিছু নেই। প্রশ্ন সাংবাদিকতার মূল ধর্ম। এখানে খুশি বা অখুশি, মানসম্মান বা ভাবমূর্তির কোনো ইস্যু নেই।
৩. প্রথম আলোর ভুল: প্রথম আলোর বক্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে, তারা শুরু থেকে ফটোকার্ডের সার্বিক কনটেন্ট নিয়ে সেলফ কনভিন্স না। পাঠক হিসেবে তাদের প্রথম প্রেজেন্টেশনে কোনো অসংগতি দেখি না। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, প্রথম আলোকে এক অজানা ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তারা দোলাচলে ভুগছেন। ফটোকার্ডটি প্রত্যাহার, ১৭ মিনিটের মাথায় সংশোধন, সংশোধন মন্তব্য ইত্যাদি কথা বলা হচ্ছে। শক্তিশালী এডিটরিয়াল বোর্ড হাউসের জন্য ভীষণ জরুরি। সাংবাদিকতায় সাধারণ সেন্স গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন বিশেষায়িত জ্ঞান।
৪. ২৬ মার্চ: কে স্বাধীনতা বা দেশকে অস্বীকার করে? দেশ মানেই তো মা। মাকে অস্বীকারের সাধ্য কার? তাই বলে মায়ের রুগ্ণ স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলব না? বাজারব্যবস্থা নিয়ে জাকির হোসেনের যে ক্ষোভ, তা তো কারও একক কারণে নয়। এ ক্ষেত্রে কারও বেশি কারও কম দায় রয়েছে। আমরা উটপাখির মতো বালুর মধ্যে মুখ খুঁজে থাকলে কি এ সত্য হারিয়ে যাবে?
দেশের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, সঙ্গে যে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়েছে, তা কি অস্বীকার করা যাবে? এ ফটোকার্ড পাঞ্চ করার জন্য ২৬ মার্চই তো এক জুতসই ক্ষণ। কারণ, এ হলো জাতির স্মৃতিস্মরণার এক বিশেষ মুহূর্ত। একে অস্থিতিশীলতা বা রাষ্ট্রবিরোধী দেখাটা পাঠক হিসেবে অতিসাধারণীকরণ বলে মনে করি। ফটোকার্ডে ব্যবহৃত ছবিটিকে যদি ছবি এবং উদ্ধৃতিতে উদ্ধৃতি হিসেবে পড়ি, তাহলে সব মিটে যায়।
সাধারণত ফটোকার্ডে অনেকগুলো মাত্রাকে একসঙ্গে ধরা হয়। থাকে টেক্সট, ছবি আর গ্রাফিকস। ফটোকার্ড সব সময় একক অর্থ উৎপাদন করে না। তার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ থাকতে পারে। ফটোকার্ড বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পড়াটাই জরুরি।
৫. সাংবাদিক শামসুজ্জামান: প্রথম আলোর এ ফটোকার্ড প্রকাশের দায়ে সাংবাদিক শামসুজ্জামান মায়ের হাত ছেড়ে অন্য হাতে চলে গেছেন। সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাষ্ট্র তো অনেক বড় সত্তা। একটি ফটোকার্ডের বিপরীতে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে যাক, সেটা মোটেও কামনা করি না।
খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগবিশেষজ্ঞ