বিশ্বের অধিকাংশ গবেষণা ও উদ্ভাবনী হয়েছে সামরিক, চিকিৎসা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে। আমার এই লেখাটি বাস্তবিক কাজে আনাড়ি একজন বয়স্ক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মানুষের দৃষ্টিতে লেখা।
অতি সম্প্রতি আমরা ডেটা অ্যানালিটিকসের কথা বলছি। উপাত্তের ওপর নানা টুলস প্রয়োগ করে তথ্যের প্যাটার্ন আবিষ্কার করে ভবিষ্যতে বিভিন্ন অর্থসংশ্লিষ্ট প্যারামিটার কী মান গ্রহণ করতে পারে, তাকে ব্যবহার করে বিনিয়োগ সুরক্ষিত করা, লাভসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটারের সুবিধাজনক মান নিশ্চিত করা।
আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যায় জর্জরিত। খাতের ব্যর্থতা এড়ানোর জন্য ঋণ অবলোপন, রিশিডিউলিং জাতীয় নানা রকম শব্দ/ধারণা আমদানি করেও সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে ঋণখেলাপিদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারছি না। সাফল্যের আশায় নীতিমালায় অহরহ পরিবর্তন আনছি, পরিকল্পনা বিঘ্নিত হচ্ছে, তাতে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও।
বিনিয়োগ, ঋণঝুঁকি নিরূপণের জন্য কত রকম ইকোনমেট্রিক মডেল রয়েছে। তারপরও শুধু ঋণই ঝুঁকির মধ্যে তাই নয়, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার পরপরই তাদের নতুন নামকরণসহ শ্রেয়তর ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে বিরূপ অবস্থা থেকে অব্যাহতি যেমন মদের পাত্র পরিবর্তন করলে মদের গুণাগুণের কোনো পরিবর্তন হয় না, তেমনই চাচ্ছি।
নাম পরিবর্তন করে আসল বিষয়ের পরিবর্তন করা যায় না। মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্বের দেশে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যয়সাশ্রয়ী হতে হবে, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক খাতের শ্রেয়তর পারফরম্যান্সের জন্য ব্যাংকগুলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই ব্যাংকই যদি মন্দ ঋণের দুষ্টচক্রে পড়ে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে অন্যান্য খাতের অবস্থা কী হবে।
যেকোনো ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জনে প্রতিযোগিতা প্রয়োজন। আমরা যেহেতু এই খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাচ্ছি না, নিশ্চয়ই আমরা সুস্থ প্রতিযোগিতাও তৈরি করতে পারছি না। অথচ ডেটা অ্যানালিটিকসের টুলগুলো যেমন রিগ্রেশন অ্যানালাইসিস, ফ্যাক্টর অ্যানালাইসিস, ক্লাস্টার অ্যানালাইসিস, প্রিন্সিপাল কম্পোনেন্ট অ্যানালাইসিস, পোর্টফোলিও অ্যানালাইসিস, টাইম সিরিজ অ্যানালাইসিস, ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস, অপটিমাইজেশনের যত রকম অ্যালগরিদম আছে, তার ব্যবহারে আমরা যেমন আমাদের বিনিয়োগ নিরাপদ করতে পারি, তেমনি আগামী দিনের অর্থনৈতিক অবস্থা অনুমান করে তার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে পারি, যাতে করে অনিশ্চয়তা ও পরিবর্তনকে নিজেদের কল্যাণে কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি।
সুখের বিষয় হলো এই টুলগুলো এখন খুবই সহজলভ্য এবং এর পেছনে খুব কম সময় ব্যয় করে ডেটা সরবরাহ করলেই ফলাফল পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, এই ফলাফল এত সুন্দর করে ভিজ্যুয়ালাইজেশন করা হয় যে ত্বরিত গতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আমার অনুমান হচ্ছে, এই শক্তিশালী টুলগুলো আমরা যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করতে পারছি না। করলে নিশ্চয়ই বারবার আমাদের নীতিমালা পরিবর্তন করতে হতো না।
সব পেশাজীবীর মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পেশাজীবীদের সংখ্যা নিয়ে বেশি কাজ করতে হয়। তবুও কেন জানি না সংখ্যার অপারেশনে তাদের স্বচ্ছন্দ মনে হয় না। আমার এই সন্দেহের একটি ছোট্ট ভিত্তি রয়েছে, যদিও তা নেহাতই ব্যক্তিগত। বয়সের কারণে হলেও অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন বোর্ডে আমার বসার সুযোগ হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরির সাক্ষাৎকারে বসতে হয়, তার মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানও আছে।
ছয়-সাত বছরের আগের কথা। এক নামকরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টিংয়ের জেনারেল ম্যানেজার পর্যায়ের চাকরির সাক্ষাৎকার প্রার্থীরা সবাই ৩৫-৫০ বছর বয়সী, বেতন আড়াই লাখ টাকা। আমি বা আমার মতো অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ স্কেলে বেতন তার এক-তৃতীয়াংশ। সাধারণত নীরব থাকি। তবুও নিজের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য করার জন্য একটি প্রশ্ন করলাম—বিনিয়োগের দুটি পলিসি-সরল সুদ ১৫ শতাংশ আর ১০ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে।
কমপক্ষে কত বছরের বিনিয়োগ হলে চক্রবৃদ্ধির বিনিয়োগ শ্রেয়তর হবে? আমাদের প্রার্থী বললেন, এর সমাধানের জন্য ক্যালকুলেটর লাগবে। খাতা-কলম এগিয়ে দিতেই বললেন, কম্পিউটার লাগবে। বাছাই বোর্ডে আবার এর সমর্থনও পাওয়া গেল। অথচ এর সমাধান কঠিন নয়: xএর সর্বনিম্ন মান যাতে 1.10 x>1 +. 15x হয়। আমি একেবারেই হতাশ হলাম। অন্য আরেকটি বোর্ডেও একই প্রশ্ন করেছিলাম। এবার প্রার্থী ভিনদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের টপার। তিনি বললেন, তিনি সরল সুদের পক্ষে এবং নিশ্চিত করলেন যত বছরেরই বিনিয়োগ হোক না কেন? এবার আমার আগের বারের হতাশা কিছুটা কেটে গেল (?!)।
বছর দশেক আগের কথা, একটি নামকরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে অভিজাত এলাকায় বিশাল অট্টালিকা তৈরি করেছে। আর্থিক বিষয়ে অত্যন্ত অভিজ্ঞ, প্রবীণ কর্মকর্তারা বোঝালেন ভবনটি অব্যবহৃত রাখলেই নাকি প্রতিষ্ঠানের লাভ!
প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি দামি যানবাহনে আগুন লাগল। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য যোগ্য কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণজনিত প্রাণচাঞ্চল্য এত বড় ক্ষতিতেও ফিকে হয়ে যায়নি। আগুনে যে বিরাট ক্ষতিটি হলো, আমার সাদা চোখ এর বাইরে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ সহকর্মীরা আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেবে!
বিভিন্ন সময়ের এই ঘটনাগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আমরা এখনো অর্বাচীন, নিয়মকানুন ঠিকমতো পালন করতে পারি না, তাই বিদেশিরা আমাদের বড় অঙ্কের জরিমানাও করে থাকে। এর মধ্যে ইতিবাচক হলো রেমিট্যান্সে আমরা পৃথিবীতে অষ্টম, যদিও গচ্ছিত অর্থের নিরাপত্তাও দিতে পারি না।
আমাদের জনঘনত্ব যতই হোক না কেন, আমাদের দক্ষতার লেভেল যদি এমন হয়, তাহলে দেশেও আমাদের জন্য সম্মানজনক চাকরির ঘাটতি হবে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই, উন্নত দেশ হতে চাই, কিন্তু আমাদের কতজন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত বিদ্যা, দক্ষতা কাজে লাগাতে পারছি? এমনকি যারা চৌকস, তারাই কি পারছে?
দেশে এখন প্রায় সব বড় মাপের কাজেই বিদেশি বিশেষজ্ঞ, পরামর্শকদের প্রয়োজন সঙ্গে সঙ্গে বড় অঙ্কের অর্থও বিদেশে পাচার হচ্ছে এ কারণে। রাষ্ট্রের, জাতির শিক্ষায় যে বিনিয়োগ, তা থেকে অর্জিত বিদ্যা দিয়ে আমরা দেশকে কতটুকু এগিয়ে নিতে পারছি? তাই অর্থনীতি আমার বিষয় না হলেও ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পরিকল্পনায়, তাদের সিদ্ধান্তে যেভাবে ডেটা অ্যানালাইটিকস ব্যবহার করতে পারে তার দু-একটি উদাহরণ তুলে ধরব। আমি নিশ্চিত এ বিষয়ে যাঁরা জ্ঞান রাখেন, অভিজ্ঞতায় পুষ্ট তাঁরা আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ দেখাতে পারবেন।
১. ঋণঝুঁকি মূল্যায়ন: কোনো ব্যক্তি কিংবা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে তার আয় ও ঋণ পরিশোধের ঐতিহাসিক তথ্য, বর্তমান আর্থিক অবস্থা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিশ্লেষণ করে ঝুঁকির সম্ভাবনা নিরূপণ করা সম্ভব। এর ফলে ব্যাংকগুলো ঋণের সিদ্ধান্ত এবং ঝুঁকির মাত্রার প্রতিফলন ঘটায় এমন সুদের হার প্রয়োগ করতে পারে। বাজারমূল্যের টাইম সিরিজ এবং ভবিষ্যৎ মূল্যের অনিশ্চয়তার প্রক্ষেপণ ব্যবহার করে বিশেষ কোনো পণ্যের ব্যবসায়ের ঝুঁকি নিরূপণ করা যায়।
সংগতিহীন পরিসম্পৎ ও দায় থেকে উদ্ভূত ঝুঁকি নিরূপণ ও নিরসনের জন্যও ডেটা অ্যানালিটিকসের টুলগুলো ব্যবহার করা যায়। ব্যাংকের পণ্য ও সেবা যেমন ঋণ, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদির চাহিদার যথাযথ প্রক্ষেপণ করতেও ইকোনমেট্রিক মডেলসমূহ ব্যবহার করা যায়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার, বেকারত্বের হার, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতির তথ্য ব্যবহার করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রক্ষেপণ করা যায়। এ ছাড়া বিনিয়োগের পোর্টফোলিও অপটিমাইজ করেও লাভের সম্ভাবনা ও ঝুঁকি নিরূপণ করতেও এই মডেলগুলো ব্যবহার করা যায়। লেনদেনের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য প্রতারণা রোধ করা সম্ভব।
২. গ্রাহকের আয়-ব্যয়ের মাত্রা, বয়স ও অন্যান্য সূচকের সাপেক্ষে গ্রাহক বিভাজন করে গ্রহণযোগ্য পণ্য ও পরিষেবার সূচনা করতে পারে। লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে শাখা এবং এটিএম মেশিনের জন্য কখন কী সংখ্যক সেবাদাতা এবং কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা নিরূপণ করতে পারে। ঋণ অনুমোদন কিংবা হিসাব খোলার কোথায় দুর্বলতা, তা চিহ্নিত করে পদ্ধতিগুলোকে ত্বরান্বিত করে গ্রাহকবান্ধব করা সম্ভব। কতগুলো টার্মিনাল হিসাব খোলার জন্য আর কতগুলো ঋণ অনুমোদনের জন্য বরাদ্দ করতে হবে এবং বছরের কিংবা দিনের কোন সময় কতগুলো লাগবে, তা টাইম সিরিজ বিশ্লেষণ করে বের করা যায়। গ্রহণযোগ্য সেবার অভাবে গ্রাহক যাতে চলে না যায়, সে ব্যবস্থাও যোগ্য সময়ে গ্রহণ করা সম্ভব। জমা, ঋণ বৃদ্ধির হার এবং সুদহারের পরিবর্তনের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে তারল্য ও সংরক্ষিত পুঁজির শ্রেয়তর ব্যবস্থাপনা করা যায়।
৩. একটি ব্যাংকের শত শত শাখা থাকে। পরবর্তী বছরে এই শাখাগুলোর বাজেট, ঋণ কিংবা অগ্রিমের প্রক্ষেপণ করতে হলে আমরা টাইম সিরিজ অ্যানালাইসিস, রিগ্রেশন অ্যানালাইসিস কিংবা নিদেনপক্ষে ডেটার স্ক্যাটার ডায়াগ্রাম তৈরি করে ধারণা নিতে পারি। এর জন্য এমনকি এক্সেলেও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। শত শত শাখার পারফরম্যান্স তুলনা করতে চাইলে রিগ্রেশন করে দেখতে পারি। যদি লাভ নির্ভরশীল চলক হয়ে থাকে, যেসব শাখার লাভ রিগ্রেশন সমতলের ওপরে অবস্থিত, তারা ভালো করছে, যারা নিচে তারা খারাপ করছে। এমনকি নানা খাতের ব্যয়কে নির্ভরশীল চলক ধরে যুক্তিসংগত স্বাধীন চলকের সঙ্গে রিগ্রেশন করেও প্রতিটি শাখা কিংবা এলাকাভিত্তিক পারফরম্যান্স তুলনা করে সুস্থ প্রতিযোগিতার সূচনা করা যায়। শত শত শাখার সাপেক্ষে নিজেদের পারফরম্যান্স দেখে শাখাগুলো নিশ্চয়ই একটি বার্তা পাবে। প্রত্যেকের পারফরম্যান্স যখন সবাই সহজে জানতে পারবে, কেউ পিছিয়ে থাকতে চাইবে না, উৎকর্ষ অর্জনে তৎপর হবে।
৪. পারফরম্যান্স অনুসারে যদি শাখাগুলোকে, ঋণ, অগ্রিম, লাভ, ক্ষতি কিংবা মন্দ ঋণের শ্রেণিবিন্যাস করতে চাই, সে ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে ক্লাস্টার অ্যানালাইসিসের অ্যালগরিদম ব্যবহার করতে পারি। অথবা প্রতিটি শাখাতে দিনের শুরুতে কত টাকা রাখতে হবে কিংবা ভল্ট সাইজ কত হবে, তা-ও কিন্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে বের করা সম্ভব।
৫. বড় বড় ব্যাংকে অনেক প্যানেল উকিল থাকেন। উকিলের সংখ্যা অনেক হলে স্বভাবতই তাঁদের পারফরম্যান্স ম্যানুয়ালি বের করা সম্ভব নয়। অনেক সময় কাজটির পরিধি এত বড় হয় যে ব্যাংকগুলো নিয়মিতভাবে উকিলদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে পারে না। অনেক সময় যথাযথ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের অবর্তমানে উকিলরাও তাঁদের কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করেন না। এমনও হয়, একই উকিলের কাছে মাত্রাতিরিক্ত মামলা থাকার ফলে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৬. অর্থনীতির কোন খাতে কোন এলাকায় বিনিয়োগ করতে হবে, তার জন্যও ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত ডেটা থাকে, যার বিশ্লেষণ করে আমরা সঠিক খাতে বিনিয়োগ ঘটাতে পারি। এমনকি কলমানিতে আগামী দিনগুলোতে কত টাকা বিনিয়োগ করা যাবে, সেগুলোও বিশ্লেষণ করে ব্যাংকের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। একইভাবে আমদানি-রপ্তানির প্যাটার্ন দেখে, টাইম সিরিজ ডেটা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে এই সংখ্যাগুলো কী রকম হবে, তার প্রক্ষেপণ করতে পারি। শুধু তা-ই নয়, প্রক্ষেপণ যদি আমদানির পরিমাণ বেশি দেখায়, তাহলে দেশের স্বার্থে আমদানির বিকল্প শিল্প খাতে যথাযথ বিনিয়োগের কথা ভাবতে পারি। এই বিশ্লেষণগুলো সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্তৃপক্ষকেও সাহায্য করতে পারে।
৭. একটি বহু শাখাসমৃদ্ধ ব্যাংকে অনেক তথ্য থাকে। এই তথ্যের ওপর ডেটা মাইনিং করে তথ্যগুলোর মধ্যে সম্পর্ক এবং তাদের মানের ওঠানামার কার্যকারণ আবিষ্কার করে তা নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে পারি।
৮. একটি বহু শাখাসমৃদ্ধ ব্যাংকে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন, যাঁদের দক্ষতা বিভিন্ন বিষয়ে, তাঁদের পদোন্নতি এবং কর্তব্যস্থল নির্ধারণের কাজটি ম্যানুয়ালি করা খুবই জটিল এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করা দুরূহ। তাই এই কাজটি কম্পিউটার এবং ম্যাচিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাপ্য উপযোগিতা সর্বাধিক করা সম্ভব।
৯. বড় বড় ব্যাংক সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করে থাকে। এই অর্থায়ন সারা দেশব্যাপী সুষম হচ্ছে কি না, অথবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনুকূলে যাচ্ছে কি না, তা কখনো ম্যানুয়ালি বের করা সম্ভব নয়। কম্পিউটার ও যথাযথ অ্যালগরিদমের ব্যবহারে এই কাজগুলো সহজভাবে করা যায়।
১০. ব্যাংকের অসংখ্য সিদ্ধান্তই সংখ্যাভিত্তিক। শুদ্ধ সিদ্ধান্তে ব্যাংকের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করার কোনো বিকল্প নেই। এমনকি পদোন্নতির জন্য প্রতি পদে কতজনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হবে, তা-ও কিন্তু কখনোই ব্যক্তিগত ধারণা থেকে করা ঠিক নয়। বিগত বছরগুলোতে এই কাজের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে করা উচিত।
১১. বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কর্মচারীদের জন্য গৃহ নির্মাণ ঋণ দিয়ে থাকে এবং যথারীতি কর্মকর্তার মৃত্যুর পরও সুদাসলের অনেকখানিই ব্যাংককে পরিশোধ করতে পারে না, মাফ করে দিতে হয়। যারা তাদের কষ্টে উপার্জিত অর্থ আমাদের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে, আমরা তাদের অর্থ কিংবা বিনিয়োগে প্রাপ্ত লভ্যাংশকে একজনের ঋণ পরিশোধের অক্ষমতার ফলে জরিমানা হিসেবে ব্যবহার করি। প্রকারান্তরে বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করি। নানা মানবিক দিক বিবেচনা করেও যদি আমাদের এই কাজটি করতে হয়, তাহলেও একজন ঋণগ্রহীতা যাতে করে এই অনভিপ্রেত অবস্থায় না পড়ে, তাদের নানা পরিসংখ্যান দিয়ে এই রকম ঋণ গ্রহণ থেকে নিরুৎসাহিত করা যায়।
১২. ব্যাংকের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার রয়েছে, যেগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার করতে পারি। যেহেতু এ বিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত, আমি সেগুলোর ওপর আলোকপাত করতে পারলাম না। আমি নিশ্চিত, প্রজ্ঞাবান ও অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদেরা আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমৃদ্ধির জন্য ইকোনমেট্রিক মডেলিং কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তার ওপর আলোকপাত করবেন।
১৩. ঋণখেলাপিদের ঋণ পরিশোধের টাইম সিরিজ দেখলেই তাদের মতলব অনেকখানি অনুমান করা সম্ভব। এমন ক্ষেত্রে রিশিডিউলিংসহ অন্যান্য প্রস্তাব ব্যাংকের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা-ও সহজে নিরূপণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত কী হওয়া উচিত, তা বের করা সম্ভব।
আমার কেন জানি মনে হয় ব্যাংকগুলোতে যে বিশাল অঙ্কের অর্থ গচ্ছিত রয়েছে, তার অপটিমাল ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের যে ব্যবহার প্রয়োজন, তা এখনো আমরা করতে পারছি না। যেকোনো সংখ্যাভিত্তিক সিদ্ধান্ত যদি আমরা ব্যক্তিগত পছন্দে ঠিক করে থাকি, তাহলে আমরা অবশ্যই ভুল করছি। যেকোনো সংখ্যা তা সুদের হার, ঋণের পরিমাণ, সময় কিংবা যা-ই হোক না কেন, তা নির্ধারিত হবে ডেটা অ্যানালিটিকসের মাধ্যমে। সীমিত সম্পদের দেশে আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত কার্যকর হোক, তাদের জুতসই সিদ্ধান্তে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে সমতা ফিরে আসুক, আমাদের অর্থনীতি উৎপাদনমুখী হোক, সম্পদের অপটিমাল বিনিয়োগ আমাদের আর্থিক অবস্থার অগ্রগতিতে অবদান রাখুক, এই কামনা করি।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস