জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবকের সাম্প্রতিক দামেস্ক সফর বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বেয়ারবক দুটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। সেই বার্তা থেকে সিরিয়া নিয়ে ইউরোপের অবস্থান বোঝা যায়। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এই সফরে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি ও রাজনীতি—দুটিই সিরিয়ার সঙ্গে জড়িত। বার্লিন এ–ও পরিষ্কার করেছে যে তারা মূলত কুর্দি জনগণের সুরক্ষায় মনোযোগ দিচ্ছে এবং সিরিয়ায় নতুন ইসলামি কাঠামোর জন্য কোনো আর্থিক সহায়তা তারা দেবে না।
জার্মানি উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করছে। এদের সিরিয়া ও তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটাই জার্মানির আর বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশের আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি। এর মূল লক্ষ্য কেন্দ্রকে দুর্বল করা। তবে তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু কুর্দিদের জন্য ন্যায়বিচার, নাগরিকত্ব বা সাংস্কৃতিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান নয়; বরং আরবিভাষী প্রধান সমাজে কুর্দিদের জন্য একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করা।
সিরিয়ার সমাজে ইসলামি কাঠামো প্রত্যাখ্যান করা জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য জার্মানির বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যনীতিকে প্রতিফলিত করে। জার্মানি মধ্যপন্থী বা চরমপন্থী যেকোনো ধরনের ‘রাজনৈতিক ইসলাম’কে প্রত্যাখ্যান করে। এর পরিবর্তে তারা ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করেছে। যদিও বাস্তব ক্ষেত্রে এদের তেমন কোনো প্রভাব বা শক্তি-সামর্থ্য নেই।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল বারো তাঁর দামেস্ক সফরে খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের রক্ষা করতে তিনি ফ্রান্সের অটল প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। অতি সেক্যুলার ফ্রান্স সব সময় ধর্ম ও জাতিগত বিভাজনের ঊর্ধ্বে থাকা প্রজাতান্ত্রিক মডেলের কথা বলে। মজার বিষয় হলো, এবার তারা পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের মুখপাত্র ও তাদের রক্ষাকারীতে পরিণত হয়েছে। এতে তাদের বহুল প্রচারিত ‘সর্বজনীন নাগরিকত্বের’ ধারণা যেন উবে গেছে।
দেশের ভেতরে সেক্যুলার প্রজাতন্ত্র আর বিদেশে খ্রিষ্টানরক্ষক—এই চমকপ্রদ বৈপরীত্য ফ্রান্সের জন্য নতুন নয়। দুই শতাব্দী আগেও ফ্রান্স ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে কঠোর যুদ্ধ চালিয়ে শিক্ষা, রাজনীতি ও জনজীবনে চার্চের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করেছিল। একই সময়ে, নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী মিসর ও লেভান্ত অঞ্চল দখল করে সেখানকার অধিবাসী বিভিন্ন খ্রিষ্টধর্মীয় গোষ্ঠীর অভিভাবক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে।
এই সুবিধাবাদী দ্বিমুখী নীতি আজও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে চলেছে। সিরিয়ার খ্রিষ্টানদের প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ফরাসি মন্ত্রী বারোর অস্বস্তি দেখে মজা লেগেছিল। বারো তাঁদের খ্রিষ্টান হিসেবে নিরাপত্তা দিতে চাইছেন। কিন্তু সিরিয়ান অর্থোডক্স খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের এক সদস্য তখন বলেছিলেন, ‘আমাদের বিদেশি সুরক্ষার প্রয়োজন নেই। আমরা শুধু চাই সব সিরিয়ানের মতো সমান নাগরিক অধিকার নিয়ে মুক্তভাবে বাঁচতে। আমরা আমাদের জন্য এবং আমাদের সব সিরিয়ান ভাইবোনের জন্য ন্যায়বিচার চাই।’
কয়েক সপ্তাহ আগেই সিরিয়ান নারীদের আত্মঘোষিত রক্ষক বেয়ারবক গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ যে ন্যায্য, তা প্রমাণ করছিলেন। গাজায় এই যুদ্ধের সময় উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের তাঁবুতে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও তখন তাঁর কাছে অন্যায় মনে হয়নি। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন হামাসের সন্ত্রাসীরা মানুষের ভিড়ে, স্কুলের আড়ালে লুকায়, তখন বেসামরিক স্থানগুলো আর সুরক্ষিত রাখা যায় না।’
নারী ও সংখ্যালঘুদের নৈতিক রক্ষক হিসেবে দেখা তো দূরের কথা, গাজা গণহত্যাকে সমর্থন করার জন্য বহু আরবীয় জার্মান সরকারকে ঘৃণা করে। এরা ইসরায়েলকে শত শত মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানির অংশীদার ছাড়া তাদের কাছে আর কিছু নয়। ফ্রান্সেরও কোনো নৈতিক অধিকার নেই সিরিয়াকে শিক্ষা দিতে আসার।
ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ আলজেরিয়া থেকে সেনেগাল—তাদের খতিয়ান ভয়াবহ। তদুপরি মিসরে সিসির শাসন এবং লিবিয়ায় সামরিক নেতা খলিফা হাফতারের মতো সামরিক অভ্যুত্থান ও নৃশংস একনায়কতন্ত্রের প্রতি সমর্থনের জন্যও ফ্রান্সকে সমালোচিত হতে হচ্ছে।
ইউরোপ আরবদের তেল, গ্যাস, সমুদ্রপথ ও বাজারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এরপরও ইউরোপীয় নেতাদের আরবাঞ্চল নিয়ে এত ঔদ্ধত্য কোথা থেকে আসে? আরবরা তা বুঝতে অক্ষম। বাস্তবে ইউরোপের মধ্যপ্রাচ্যকে যতটা প্রয়োজন, মধ্যপ্রাচ্যের ইউরোপকে তার চেয়ে অনেক কম। কারণ, বিশ্বের শক্তির ভারসাম্যে আজ ফ্রান্স, জার্মানি বা যুক্তরাজ্য কেবল মাঝারি মানের খেলোয়াড়। তাদের একটু বাস্তবতা বোঝা দরকার। আর সম্ভব হলে একটু বিনয়।
● সুমাইয়া ঘানুসি ব্রিটিশ-তিউনিসীয় লেখক, মধ্যপ্রাচ্যবিশেষজ্ঞ
মিডল ইস্ট আই, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন