সুন্দরবনে আবারও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার বনের চাঁদপাই অঞ্চলের আমুরবুনিয়া এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের খবর আমরা পাই। সুন্দরবন একটি দুর্গম এলাকা, ঘন গাছপালায় ভর্তি, কোনো রাস্তা নেই। কাছাকাছি পানির তেমন কোনো উৎসও নেই। এ ছাড়া বাঘের উপস্থিতি থাকায় ঝুঁকিও আছে। অনেক সময় আগুনের বিস্তার কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়ায়। ফলে সুন্দরবনে পুরোপুরি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কাজটি সহজ হয় না। এবারও কয়েকদিন সময় লেগে যায় আগুন নেভাতে। গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, সুন্দরবনের এ আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
সুন্দরবনে গত ২২ বছরে ২৫ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এর অধিকাংশ ঘটেছে সুন্দরবনের ২৭ নম্বর কম্পার্টমেন্টে। এলাকাটি সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের উত্তর সীমানা সংলগ্ন জয়মনি থেকে শরণখোলার দাসের ভারানি পর্যন্ত।
পৃথিবীর নানা দেশের বনাঞ্চলে আগুন লাগার ঘটনা আমরা জানি। এগুলোর অধিকাংশ প্রাকৃতিকভাবে সূত্রপাত হয়, পরে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত, বনের মাটি ভেজা, কাদাযুক্ত। ফলে এখানকার আবহাওয়া ও বনভূমি প্রাকৃতিকভাবে আগুন লাগার উপযোগী নয়।
যদিও আমুরবুনিয়া এলাকা কিছুটা উঁচু, শুকনো। তাই এটি ধরেই নেওয়া যায়, সুন্দরবনে আগুনের যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা মূলত মানুষের দ্বারা সূত্রপাত হয়। তবে আমি বিশ্বাস করি, যে মানুষ সুন্দরবনের মাছ-কাঁকড়া ও গোলপাতা আহরণ করে পরিবারের মুখে দুমোঠো খাবার জোগান দেয় সে সজ্ঞানে কখনো আগুন লাগাতে পারে না। আবার প্রতিবছর আগুন লাগার ঘটনা যে দৈবাৎ সেটিও বিশ্বাস করা কঠিন।
তাহলে এটি ধরে নেওয়া যায় কোনো দুষ্কৃতকারী এই শুকনো মৌসুম আসার অপেক্ষায় ওত পেতে থাকে। কারা সেই অপরাধী যাদেরকে আমরা বছরের পর বছর চিহ্নিত করতে পারছি না। এমন আত্মঘাতী কাজ করে তারা কীভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে এটি একটি বড় প্রশ্ন। সুন্দরবনে আগুন লাগার এই দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে এদেরকে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিয়মিতভাবে সুন্দরবনে আগুন লেগে পোড়ার কারণে বনের এই জায়গা এখন ‘পোড়ামহল’ নামে পরিচিত। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পোড়ামহল দেখতে যাই সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে। বনতলের বিস্তীর্ণ এলাকায় তখনো গত বছরের আগুনের পোড়া ডালপালা চোখে পড়ে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আগুন লাগার নানা বিষয় অবগত হই।
স্থানীয়দের অনেকের মতে, আগুন লাগা এলাকার গাছ এক সময় মরে গেলে বাতাসে ওপড়ে পড়ে। এতে উপড়ে পড়া স্থানে যে গর্তের সৃষ্টি হয় সেখানে বর্ষায় পানি জমে কই, মাগুর, শিং ইত্যাদি মাছের উত্তম আবাস সৃষ্টি হয়। শীতকালে পানি কমে এলে এ সকল গর্ত সমৃদ্ধ মিষ্টি পানির জলাভূমি থেকে প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ীরা দাদনের মাধ্যমে প্রান্তিক জেলেদের দিয়ে মাছ আহরণ করে।
প্রতিবছর বনে আগুন লাগার ঘটনার সঙ্গে এদের যোগসাজশ থাকতে পারে বলে স্থানীয় অনেকের অভিমত। তদন্তে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে।
সুন্দরবনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো জোয়ারের পানিতে বনতল প্লাবিত হওয়া, আর ভাটায় পানি নেমে যাওয়া। তবে ঋতুভেদে এর তারতম্য দেখা যায়। যেমন শীতকালে সুন্দরবনে জোয়ারের তীব্রতা বর্ষার তুলনায় কম, ফলে এ সময়ের জোয়ার বনতলকে কম প্লাবিত করে। বিশেষ করে চাঁদপাই রেঞ্জের পশ্চিমের কাটাখালী থেকে পুবের দাসের ভারানি পর্যন্ত উত্তরের সীমানা থেকে দক্ষিণে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার এলাকার বন কিছুটা উঁচু। ফলে বর্ষার ভারি বৃষ্টি ছাড়া এলাকার বনাঞ্চলে সারা বছরেও পানি উঠে না।
সুন্দরবনের এ এলাকার উত্তরের সীমানা খরমা নদী, এটি ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। ভাটার সময় একেবারে শুকিয়ে যায়, জোয়ারের সময় ভোলা নদ থেকে কিছুটা পানি আসে।
বর্তমানে উজানের নদীর সঙ্গে খরমা নদীর সংযোগ নেই বললেই চলে। ফলে এ এলাকার বনাঞ্চল শুকনো। সারা বছর গাছের পাতা ঝরে বনতলে শুষ্ক পাতার গভীর স্তর সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে খুব সহজে যেমন আগুন লাগানো যায়, তেমনি আগুন লাগলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
অনেকের মতে, মৌয়ালিরা মধু আহরণের জন্য যে মশাল (মৌয়ালিদের ভাষায় কারু) ব্যবহার করে, মধু কাটার পর সেটি ফেলে আসে। ফলে এই মশাল থেকে আগুন লাগতে পারে। আবার বনজীবীদের বিড়ি-সিগারেটে থেকে আগুন লাগার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদি এমনটি হয়েই থাকে তবে গত কয়েক দিনে যারা পাশ নিয়ে ওই এলাকার বনে প্রবেশ করেছেন তাদেরকে তদন্তের আওতায় আনা যায় কি না তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
চাঁদপাই থেকে দাসের ভারানি পর্যন্ত সুন্দরবনের সীমানা এলাকায় যে দু একটি খাল এখনো অবশিষ্ট আছে, সেগুলোতে এলাকার প্রভাবশালীদের একচেটিয়াভাবে বছরের পর বছর ধরে মাছ ধরার অভিযোগ আছে। সে সব খালে অন্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন। মুষ্টিমেয় প্রভাবশালীরা অবৈধ সুবিধা পেলে বঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমন ক্ষোভ থেকেও এমন ঘটনা ঘটছে বলে স্থানীয় কেউ কেউ মনে করেন।
গত কয়েক দশকে খরমা নদীর উত্তর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠেছে মাছের ঘের, বেড়ি বাঁধের এখানে সেখানে বসেছে স্লুইসগেট যার বেশির ভাগ অচল, এবং স্লুইসগেট সংলগ্ন উত্তরের খাল বেদখল হয়েছে দেশের আর পাঁচটা নদী-খালের মতোই। ফলে খরমা নদীতে আজ পানি নেই। খরমার সঙ্গে ধীরে ধীরে পুবের ভোলা নদীও মরতে বসেছে। এ সকল খাল খনন করে সুন্দরবনের এই অঞ্চলে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।
ইতিপূর্বে আগুন লাগার ঘটনা উদ্ঘাটনে প্রতিবার তদন্ত কমিটি হয়েছে। সরাসরি কোনো দুষ্কৃতকারী চিহ্নিত হয়েছে কি না তা জানা না গেলেও কমিটি বেশ কিছু সুপারিশমালা প্রদান করেছেন।
এর মধ্যে বন সংলগ্ন খাল খনন ও পুকুর খনন, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি, বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার, সীমানা বরাবর নাইলনের বেড়া তৈরি, ইত্যাদি। কিছু কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু হলেও অধিকাংশ সুপারিশ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বিশেষ করে খাল খননের মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশটি।
সুন্দরবন লাগোয়া চাঁদপাই বাজার থেকে পুবের শরণখোলার দাসের ভারানি পর্যন্ত সুন্দরবনের সীমানা গড়ে দিয়েছে খরমা নদী। অতীতে এ অঞ্চলের বনতল সজীব রাখত এ নদীর নানা শাখা-প্রশাখা। উজানের বান্দাকাটা নদী এক সময় পানগুচি ও চিলা নদী থেকে নানা পথে খরমা নদীতে মিষ্টি পানি নিয়ে আসত। এ ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি নদী পানি প্রবাহিত করত খরমা নদীতে। খরমা নদীর মাধ্যমে সে পানি প্রবাহিত হতো ভাটির সুন্দরবনে।
কিন্তু গত কয়েক দশকে খরমা নদীর উত্তর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠেছে মাছের ঘের, বেড়ি বাঁধের এখানে সেখানে বসেছে স্লুইসগেট যার বেশির ভাগ অচল, এবং স্লুইসগেট সংলগ্ন উত্তরের খাল বেদখল হয়েছে দেশের আর পাঁচটা নদী-খালের মতোই। ফলে খরমা নদীতে আজ পানি নেই।
খরমার সঙ্গে ধীরে ধীরে পুবের ভোলা নদীও মরতে বসেছে। এ সকল খাল খনন করে সুন্দরবনের এই অঞ্চলে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। এতে ম্যানগ্রোভ বনের স্বাভাবিক অবস্থা যেমন ফিরে আসবে, তেমনি শীতকালে বনতল এতটা শুকনো হবে না। ফলে আগুনের ঝুঁকি কমবে।
দ্বিতীয়ত, আগুন নেভাতে এখন নিকটবর্তী কোনো এলাকায় প্রয়োজনীয় পানি নেই। নিকটবর্তী পানির উৎস কয়েক কিলোমিটার দূরে। ফলে এত দূর থেকে পানি নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা হয়তো ফায়ার সার্ভিসেরও নেই। খরমা নদী ও এর শাখা খালের পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারলে এমন দুর্যোগের সময় এ সকল খাল থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ সহজ হবে।
অতীতের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শীতের শেষের দিকে অধিকাংশ আগুনের ঘটনাগুলো ঘটছে। এ ছাড়া এ সময় বনের এই এলাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। তদুপরি সারা দেশে চলছে তাপপ্রবাহ। এ সব বিবেচনায় নিয়ে এ সময় সুন্দরবনের এই এলাকা কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখার প্রয়োজন ছিল। আর যেহেতু প্রতিবছরই এমনটি ঘটছে, তাই শীতকালের এই সময় এ এলাকায় বনজীবীদের পাশ বন্ধ করে টহল জোরদার করা যেতে পারে। সে সঙ্গে বন বিভাগের দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান অপরিহার্য।
শীতের শুরুতেই শুষ্কপ্রবণ এ এলাকায় ফায়ার লাইন তৈরি করা যেতে পারে। ইতিপূর্বে সংঘটিত আগুন লাগার স্থানগুলো বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত এলাকায় আগে থেকেই ফায়ার লাইন করা যেতে পারে। সুন্দরবনের আগুন ওপরের দিক দিয়ে কম ছড়ায়, ফলে ফায়ার লাইনের মাধ্যমে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হতে পারে।
সুন্দরবন পৃথিবীতে একটিই। আমাদের গৌরব করার মতো সুন্দরবন ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এ ছাড়া এটি বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। তাই সুন্দরবন সুরক্ষায় বিশ্ববাসীর নিকট আমাদের যেমন দায়বদ্ধতা আছে, তেমনি আছে নিজেদের গর্বের জায়গাটি সমুন্নত রাখা।
ড. এম এ আজিজ সুন্দরবন ও বাঘ গবেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক