১৯৯৮ সালের অক্টোবর। নওয়াজ শরিফের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বকাল চলছে। সেনাপ্রধান জেনারেল জাহাঙ্গীর কারামতকে অপসারণের মাধ্যমে সাময়িক একটা বিজয় পেলেন নওয়াজ। রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিরোধের জেরে সেনাপ্রধানকে সরিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এটি ছিল নওয়াজের জন্য ভাগ্যনির্ধারক এক সিদ্ধান্ত। দুজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলকে সরিয়ে পারভেজ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দিলেন নওয়াজ।
কয়েক মাস পেরোতেই নওয়াজ ঠিকই বুঝলেন কতটা বাজে ছিল তাঁর সেই সিদ্ধান্ত। সে সময় ইসলামাবাদে উপরাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলাম আমি। মোশাররফ সম্পর্কে পাকিস্তানের এক রাজনীতিবিদের মতামত জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, মোশাররফ অত্যন্ত দুঃসাহসী।
এক বছর যেতে না যেতেই মোশাররফ তাঁর সেই দুঃসাহসের একের পর এক নজির স্থাপন করে চললেন। কারগিল যুদ্ধ, ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে নিজ দেশে সেনা-অভ্যুত্থান এবং সাংবিধানিক রীতিনীতি ছুড়ে ফেলে জনগণের ওপর কঠোর স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেওয়াসহ সবকিছুই ঘটে চলল।
অভ্যুত্থানের পর মোশাররফ সংবিধান স্থগিত করেন এবং সেনাপ্রধান পদে থেকেও প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করেন। প্রথম তিন বছরের জন্য তিনি কুখ্যাত ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ চালু করেন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বাধ্য করেন তাঁর শাসন ও কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিতে। ২০০১ সালের জুন মাসে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০২ সালের এপ্রিলে ভুয়া গণভোটে ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে পাঁচ বছরের জন্য নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করেন। ওই বছরের আগস্টে ব্যাপক কলাকৌশলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বদলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ফিরিয়ে এনে সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করেন এবং নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
মোশাররফের শাসনকালে যাঁরা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা দু-একজন হয়তো তাঁর মৃত্যুতে শোক জানাবেন। আইয়ুব খান, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফ—তাঁরা তিনজন এমন এক শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে থেকে যাবেন, যা কিনা রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অকার্যকারিতার পেছনে একমাত্র কারণ।
ব্যাপক কারচুপির নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ ভেঙে গঠিত হওয়া পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কিউ) ক্ষমতায় আসে। মোশাররফের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া এ দল কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছিল, জন-অসন্তোষের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতা বাড়তে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর মেয়াদ নবায়নের দরকার পড়ে। সেনাপ্রধান পদে থেকে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবারও ৯৮ শতাংশ ভোট তাঁর ঝুলিতে আসে।
কিন্তু দুই পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট সে নির্বাচন বাতিল করলে তিনি স্বল্পকালের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। আবার সংবিধান স্থগিত করেন এবং প্রধান বিচারপতিসহ আরও কয়েকজন বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করান। কিন্তু ক্রমবর্ধিত রাজনৈতিক চাপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত সামরিক উর্দি ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জয়লাভ করলে অভিশংসনে পড়ার ভয়ে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়েন মোশাররফ। পাকিস্তান থেকে লন্ডনে চলে যান। ২০১৩ সালে পাকিস্তানে ফিরে এলেও তাঁর রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণ হয়নি। নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় এলে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় মোশাররফকে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ২০১৬ সালে দুবাইয়ে পালিয়ে যান তিনি। বিশেষ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জোরালো বিরোধিতা আসে।
মোশাররফ নিজেকে ‘আলোকপ্রাপ্ত মধ্যপন্থী’ বলে প্রচার করতেন। যা-ই হোক, তিনি উগ্রপন্থীদের নিজের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রপন্থার ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে মোশাররফ মাদ্রাসা সংস্কারের যে প্রকল্প নিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা চরম ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে চলে আসে ৯/১১।
এ ঘটনাকে মোশাররফ আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর বৈধতা অর্জনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেন। নিজে দেশে সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান সামনের সারির মিত্রে পরিণত হয়। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানে ‘ভালো সন্ত্রাসী ও মন্দ সন্ত্রাসী’ নীতির জন্ম হয়। শেষ পর্যন্ত নিজেদের জন্ম দেওয়া এ ধরনের কিছু সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং দেশে সহিংসতা শুরু করে।
মোশাররফের শাসনকালে যাঁরা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা দু-একজন হয়তো তাঁর মৃত্যুতে শোক জানাবেন। আইয়ুব খান, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফ—তাঁরা তিনজন এমন এক শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে থেকে যাবেন, যা কিনা রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অকার্যকারিতার পেছনে একমাত্র কারণ।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
শরৎ সাভারওয়াল, পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত