একের পর এক যা ঘটছে তা কি ‘স্বাভাবিক’

সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে নেওয়ার সময় তাঁর অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান আটকে দেন। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে।ছবি: সৌরভ দাশ

এই সপ্তাহের শুরু থেকে কী কী ঘটেছে? দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোন ইস্যুতে বিশৃঙ্খলা, সংঘাত ও সহিংসতা ঘটছে।

গত রোববার ও সোমবার বিভিন্ন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষে পুরান ঢাকা ও যাত্রাবাড়ী পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। এ সময় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল লক্ষ্মীবাজার ও জনসন রোডসহ পুরান ঢাকার বড় এলাকা। সোমবার দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ডেমরা অংশ। এই দুই দিনে হামলা শিকার হয় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একটি হাসপাতাল। এসব হামলায় তিন তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সেখানে এখন শিক্ষা কার্যক্রম চলার উপায় নেই। রোববার রাতে তেজগাঁওয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

একই সময়ে এই দুই দিন প্রথম আলো কার্যালয়ের সমানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। রোববার ঢাকার প্রেসক্লাব, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও ধানমন্ডি এলাকা অবরুদ্ধ ছিল ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের আন্দোলনে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ ছিল ঢাকা–ময়মনসিংহ সড়ক। সোমবার শাহবাগে ‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনের উদ্যোগে লোক জমায়েতের চেষ্টা হয়েছে। ঋণ দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাদের ঢাকায় আনা হয়।

আর মঙ্গলবার চট্টগ্রামে ঘটেছে ভয়াবহ ঘটনা। সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার ও তাঁকে কারাগারে পাঠানোকে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর অনুসারীরা যে পরিস্থিতি তৈরি করেন তাতে নৃশংসভাবে খুন হন সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সপ্তাহে একের পর এক যে ঘটনাগুলো ঘটল তা কি স্বাভাবিক? সবগুলোকেই কি বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খলার ঘটনা? অথবা গণ-অভ্যুত্থানের পর ধারাবাহিকভাবে যেসব ঘটনা ঘটেছে; সেই আনসার সদস্যদের সচিবালয় ঘেরাও থেকে শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বা তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবি—এগুলোকে নিছক নির্দোষ আন্দোলন? নাকি অন্য কিছু ভাবার সুযোগ রয়েছে?

এসব ঘটনাগুলো জনমনে একই সঙ্গে হতাশা ও উৎকণ্ঠা তৈরি করছে। কারণ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মানুষের মনে অনেক আশা জাগিয়েছে এবং এই গণ-অভ্যুত্থান সফল করতে অনেক রক্ত ঝরেছে। মানুষের মনে প্রশ্ন, এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? সবচেয়ে বড় কথা সরকার নিজেও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তারা মনে করছে পরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সোমবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন, বড় কোনো পরিকল্পনা না থাকলে একদিনে (রোববার) এতগুলো ঘটনা কাকতালীয় নয়। সরকার সফলভাবে কাজ করুক এটা হয়তো অনেকেই চাইছে না। সরকার ও তথ্য উপদেষ্টা মনে করছেন এখানে নানা পক্ষের পরিকল্পনা আছে।

এই ‘নানা পক্ষের’ মধ্যে একটি পক্ষের কথা তথ্য উপদেষ্টা নিজেই স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে।

গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ও সহায়ক রাজনৈতিক শক্তিগুলোও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন। বিএনপি ও জামায়াত—দুটি দলও মনে করে যে দেশে যে সংঘাত ও সহিংসতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার পেছনে পতিত স্বৈরাচার এবং দেশের ভেতর ও বাইরে তাদের দোসরেরা নেপথ্যে থেকে কাজ করছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব চলমান সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনায় সবাইকে ‘সজাগ ও সতর্ক’ থাকতে বলেছেন। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই বলে দলটি মনে করে। জামায়াতে ইসলামীর আমির এক বিবৃতিতে বলেছেন, একটি গোষ্ঠী পতিত স্বৈরাচারের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশকে অস্থির করার জন্য ক্রমাগতভাবে দুরভিসন্ধি ও অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে এসব ঘটনার পেছনে যে পতিত স্বৈরাচারী সরকার এবং তাদের দেশে ও বিদেশে থাকা তাদের দোসরদের হাত রয়েছে এ ব্যাপারে সব পক্ষই একমত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পতিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে কারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে এবং কীভাবে তারা তা করতে পারছে? তাদেরকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না কেন? আর শুধু পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরাই কি নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে নাকি আরও কোনো পক্ষ সক্রিয় রয়েছে? তাদের কি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য বা এজেন্ডা রয়েছে?

চট্টগ্রামে মঙ্গলবার আদালত প্রাঙ্গণে যা ঘটেছে এবং এর পরিণতিতে আইনজীবী হত্যার যে ঘটনা ঘটল তা এড়াতে না পারার দায় সরকারকে নিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ের নানা ঘটনা বিশেষ করে চট্টগ্রামের হাজারী লেনের ঘটনা কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাথায় ছিল?

অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সাড়ে তিন মাসের বেশি সময়কালে বিভিন্ন আন্দোলন ও বিক্ষোভ মোকাবিলায় খুবই নমনীয়তার নীতি নিয়েছে। জনগণের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের সরকার হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতেই সম্ভবত এই নীতি নেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বক্তব্যেও সব ক্ষেত্রে একটি নমনীয় অবস্থান নেওয়ার সুর পাওয়া গেছে।

সবকিছু মিলিয়ে সরকারের এমন একটি ইমেজ দাঁড়িয়েছে যে কোনো ক্ষেত্রে তারা বল প্রয়োগের নীতি নেবে না। কিন্তু একটি সহিংস গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন দেশের রাষ্ট্র শাসনের পুরো কাঠামো লন্ডভন্ড হয়ে গেছে তখন এই নীতি কতটা ফলদায়ক সে প্রশ্ন তোলা খুবই স্বাভাবিক। কোনো কোনো পক্ষ হয়তো এরই সুযোগ নিচ্ছে।

কিছু উপদেষ্টার যোগ্যতা-দক্ষতা প্রশ্ন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি, সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তা বাতিল করা বা আন্দোলন-বিক্ষোভ দমনে নমনীয় অবস্থান বা আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘাটতি—এসব কারণে অনেকেই ধরে নিতে শুরু করেছেন যে এই সরকার দুর্বল।

চট্টগ্রামে মঙ্গলবার আদালত প্রাঙ্গণে যা ঘটেছে এবং এর পরিণতিতে আইনজীবী হত্যার যে ঘটনা ঘটল তা এড়াতে না পারার দায় সরকারকে নিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ের নানা ঘটনা বিশেষ করে চট্টগ্রামের হাজারী লেনের ঘটনা কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাথায় ছিল?

যদি তা থাকত তবে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার ও আদালতে হাজির করা হলে সম্ভাব্য কী ঘটতে পারে তা তারা বিবেচনায় নিত। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে ব্রহ্মচারীকে কেন আদালতে হাজির করা হলো? সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি এ ব্যাপারে কোনো আগাম সতর্কতা দিতে পারেনি?

দেশে বর্তমানে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাছ থেকে আগাম তথ্য পাওয়া গেলে আগেভাগেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। শাহবাগে সোমবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে প্রলোভন দেখিয়ে যেভাবে ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব হলো, সেই ঘটনাটিও গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতির বিষয়টি নিশ্চিত করে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে যখন পতিত স্বৈরচারের দোসর, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও অশুভ শক্তি নিজের স্বার্থ হাসিলে মাঠে তৎপর রয়েছে তখন এই সব দুর্বলতাগুলো বিপদ ডেকে আনতে পারে।

মঙ্গলবার চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার ঘটনার পর আরও সংঘাত ও সহিংসতার যে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল তা এড়ানো গেছে—এটা খুবই স্বস্তির বিষয়। ঘটনার পরপরই গণ-অভ্যুত্থানের নেতারা সক্রিয় হয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা শান্তি শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও এ ব্যাপারে সরব হয়েছে। বোঝা গেল গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সমাজ ও সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলো যে কোনো ষড়যন্ত্র, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে সতর্ক থাকলে পতিত স্বৈরশাসকের দোসর বা অন্য কোনো অশুভ শক্তি খুব সুবিধা করতে পারবে না।

  • এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]