সব ক্ষেত্রে বিরোধ আর সাপে-নেউলে সম্পর্ক থাকলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ আর ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের মধ্যে একটি বিষয়ে দারুণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। দুটি ছাত্র সংগঠনেরই শীর্ষ নেতৃত্বের নিয়মিত ছাত্রত্বের বয়স অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য শিক্ষার্থী। নিয়মিত শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ায় ছাত্র হিসেবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরা সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হয়ে আছেন। ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বয়স এখন ৩২-এর আশপাশে। আর ছাত্রদলের শীর্ষ দুই নেতার বয়স ৩৮ ও ৩৫।
মজার ব্যাপার হলো, দুই সংগঠনেরই শীর্ষ নেতারা বয়স্ক হয়ে যাওয়ার একই দোষে দুষ্ট হলেও একে অপরের দিকে বয়স নিয়ে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। ছাত্রলীগের নেতারা ছাত্রদলের নেতাদের ‘অছাত্র’ ও ‘চাচ্চু’ বলে সম্বোধন করেন। অন্যদিকে ছাত্রদলের নেতারা ছাত্রলীগের নেতাদের ‘ছাত্রত্ব নেই’ ও ‘সন্ত্রাসে জড়িত’ বলে অভিযোগ করছেন।
অছাত্র ও বয়স্ক ব্যক্তিদের ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতৃত্বে রাখার রেওয়াজ অনেক পুরোনো। চল্লিশোর্ধ্ব, বিবাহিত, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, সন্তানের বাবা ‘ছাত্ররা’ও একসময় ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের কারণে বিখ্যাত ‘আদু ভাই’ চরিত্রটি গল্পের বই থেকে বেরিয়ে বাস্তব চরিত্র হিসেবে আবির্ভূতও হয়েছিল। এরশাদের আমলসহ ইতিহাসের বড় একটা সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা ছিল সেশন জট। চার বছরের শিক্ষাজীবন শেষ হতে সময় লেগে যেত সাত-আট বছর। আন্দোলন হলেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখাকেই একমাত্র সমাধান ভাবতেন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা। কুখ্যাত এই সেশন জট নেতৃত্বের জট সৃষ্টিতে একটা ভূমিকা পালন করলেও সেটা কোনোভাবেই প্রধান কারণ নয়।
মূল কারণ হলো, মুখে গণতন্ত্রের নামে ফেনা তুলে ফেললেও আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের চর্চা সামান্য। ফলে ছাত্র সংগঠনেও নেতৃত্ব নির্বাচনে কোনো মানদণ্ড তৈরি হয়নি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতা নির্বাচিত হন। আবার ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা (স্বজনপ্রীতি ও টাকার বিনিময়ে নেতৃত্ব বিক্রির অভিযোগও ব্যাপক) সে ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
সংগঠন দুটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলনের মাধ্যমে সদস্যদের ভোটে দুই বছর অন্তর নেতা নির্বাচনের বিধান থাকলেও সেই প্রক্রিয়ার ধারেকাছেও যাওয়া হয় না। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সরাসরি আশীর্বাদে মনোনীত হওয়ায় কারও কাছে জবাবদিহির বালাই নেই। তাহলে, এ ধরনের ছাত্র রাজনীতি টিকে থাকার ভিত্তি কী?
বয়স্ক ব্যক্তিদের নেতা বানানোর পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি টিকেই আছে নিপীড়নের ওপর ভিত্তি করে। ১৮-১৯ বছর বয়সী যে শিক্ষার্থী গ্রাম বা মফস্বল থেকে পড়তে আসছেন, সেই শিক্ষার্থী যখন দেখেন, তাঁর দ্বিগুণ বয়সী কেউ (শুধু বয়স নয় শরীর-স্বাস্থ্যেও) প্রচণ্ড প্রতাপ নিয়ে নেতাগিরি করছেন, প্রথম দর্শনেই তাঁর ভেতর ভয়ের বোধ তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীদের কল্যাণ, তাঁদের মানসিক বিকাশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এসব ছাত্র সংগঠন নয়। বরং ক্ষমতার রাজনীতির বৈতরণি পার হওয়ার কিংবা সেটা টিকিয়ে রাখার ঠাঙাড়ে বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার বাস্তবতাটাই এখানে মূল বিষয়।
ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে কেন অছাত্র ও বয়স্ক ব্যক্তিরা থাকবেন, এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তুমুল সমালোচনা রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ২৩-২৪ বছরের মধ্যে স্বাভাবিক উচ্চশিক্ষার সমাপ্তি হয়। ফলে কোনোভাবেই ২৫-২৬ বছরের বেশি বয়স্ক কারও নিয়মিত ছাত্র থাকার বাস্তবতা কম।
সমালোচনার মুখে একসময় ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে বয়সের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেটা বিভিন্ন মহলে সাধুবাদও পেয়েছিল। ২০১১ সালে সংগঠনটির ২৭তম সম্মেলনে এসে নেতৃত্বে প্রবেশের বয়স ২৭ বছর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এরপর গত ১১ বছরে মাত্র দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নেতৃত্বে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা থাকলেও শেষ হওয়ার বয়সসীমা নেই। ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৮ সালের মে মাসে। ওই বছরের জুলাইয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও গোলাম রাব্বানী। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবিসহ নানা অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পদ হারান দুজন। তাঁদের স্থলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় আল নাহিয়ান খান ও লেখক ভট্টাচার্যকে। ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আল নাহিয়ান খান ও লেখক ভট্টাচার্যকে ‘ভারমুক্ত’ করা হয়। ১০ মাসের জন্য এ কমিটি থাকলেও তিন বছর পার হতে চলেছে।
শুধু জয় আর লেখক নন, তাঁদের সঙ্গে বয়স্ক হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রায় সব ইউনিটের নেতারা। ছাত্রত্ব বজায় রাখার জন্য তাঁদের অনেককেই সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হওয়ার কৌশল নিতে হচ্ছে। ফলে পরিবর্তনের আভাস দেওয়ার পরও ছাত্রলীগ আবার সেই পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে এসেছে।
সেদিক থেকে ছাত্রদল কম বয়সী ও নিয়মিত ছাত্রদের নেতা নির্বাচিত করার প্রচেষ্টা নেয়নি। এ বছরের এপ্রিল মাসে সর্বশেষ কমিটির ঘোষণা দেওয়া হয়। ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ—দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র। রওনকুল ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। বাংলা বিভাগ থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি এখন তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ (সান্ধ্য কোর্স) থেকে আবার স্নাতকোত্তর করছেন। সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ ভর্তি হয়েছিলেন ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে। বাংলা বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষে এখন সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর (সান্ধ্য কোর্স) করছেন তিনি। রওনকুলের বয়স প্রায় ৩৮ আর সাইফের বয়স প্রায় ৩৫ বছর।
সংগঠন দুটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলনের মাধ্যমে সদস্যদের ভোটে দুই বছর অন্তর নেতা নির্বাচনের বিধান থাকলেও সেই প্রক্রিয়ার ধারেকাছেও যাওয়া হয় না। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সরাসরি আশীর্বাদে মনোনীত হওয়ায় কারও কাছে জবাবদিহির বালাই নেই। তাহলে, এ ধরনের ছাত্র রাজনীতি টিকে থাকার ভিত্তি কী? গত ৩১ মে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘অছাত্র’ আর ‘ছাত্রত্ব নেই’ বিতর্কে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল শিরোনামের প্রতিবেদনটির অংশবিশেষের দিকে নজর দেওয়া যাক। ছাত্রদলের নেতৃত্বে কেন বয়স্করা? এমন প্রশ্নের উত্তরে সংগঠনটির নেতারা বলেন, বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো এককভাবে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় ছাত্রদল ‘প্রত্যাশিত মাত্রায়’ কর্মী সংগ্রহ করতে পারেনি।
তেতো হলেও সত্য যে আবাসিক হল আর গণরুমকে কেন্দ্র করেই ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের ছাত্র রাজনীতি টিকে থাকে। শিক্ষার্থী নিপীড়ন ও জবরদস্তির এই যন্ত্র ছাড়া তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি এখন প্রায় অস্তিত্বশূন্য।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক