চরম উত্তেজনা ও সহিংসতার পর ১৫ জুলাই শ্রীলঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার এবং ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। যে বিক্ষুব্ধ জনতা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন এবং অফিস দখল করে রেখেছিল, তারা নাগরিক সমাজের নেতাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলো খালি করে দিয়েছে। তাদের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠা গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন এবং সিঙ্গাপুর থেকে ই-মেইলে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এখন যে প্রশ্ন উঠেছে: এবার কি শান্তি স্থায়ী হবে? রনিল বিক্রমাসিংহের অধীন প্রশাসনকে সাময়িক কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক নেতারা ও আন্দোলনকারীরা কি মেনে নেবেন? আন্দোলনকারীরা ও গণমাধ্যম বিক্রমাসিংহেকে রাজাপক্ষে গোষ্ঠীর অনুগত একজন ‘ভাঁড়’ হিসেবে দেখে আসছে।
সে কারণে প্রশ্ন ওঠে, পার্লামেন্টে বিভক্ত রাজনীতিবিদেরা কি তাঁদের মতভেদ ভুলে আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী সর্বদলীয় সরকার গঠনে এক হতে পারবেন? সর্বোপরি, সরকার কি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, বিশেষ করে জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার জোগাড় করতে পারবে? সরবরাহ ও বিতরণব্যবস্থা কি মজুতদার ও মুনাফাখোরদের কবল থেকে মুক্ত হবে? শ্রীলঙ্কানরা এখন এ প্রশ্নে আঙুল তুলছেন।
বেশির ভাগ সহিংসতার সময় শ্রীলঙ্কার আইনশৃঙ্খলা যন্ত্র নীরব দর্শক হয়ে ছিল; কারণ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার কাছ থেকে তারা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়ে কোনো আদেশ বা নির্দেশনা পাচ্ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ নির্লিপ্ততা উগ্রপন্থী ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির (এফএসপি) নেতৃত্বে রাস্তায় নামা সহিংস গোষ্ঠীগুলোকে গত ৯ মে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের গাড়ি ও বাড়ি এবং ৯ জুলাই কলম্বোয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পুড়িয়ে দিতে উৎসাহ জুগিয়েছিল।
৯ জুলাইয়ের ঘটনাগুলো একদিকে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াকে শ্রীলঙ্কা থেকে পালাতে এবং সিঙ্গাপুর থেকে তাঁর পদত্যাগ জমা দিতে বাধ্য করেছে। অন্যদিকে সেই দিনটি সহিংসতা এবং অন্যান্য বেআইনি কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে সংযমের পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল। এরপর সুশীল সমাজ নৈরাজ্যের আশঙ্কায় জেগে ওঠে। ক্যাথলিক ও বৌদ্ধ ধর্মযাজকেরা, বার অ্যাসোসিয়েশন অব শ্রীলঙ্কা, সিলন চেম্বার অব কমার্স এবং নেতৃস্থানীয় দৈনিকগুলোর বেশির ভাগ সম্পাদকীয় সহিংসতা বন্ধ এবং সাংবিধানিক পথে ফিরে আসার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানায়।
‘নিরপেক্ষ’ দলগুলোর একটি গ্রুপ বিবৃতি দিয়ে বলেছে, সহিংসতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শ্রীলঙ্কাকে বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পার্লামেন্ট সদস্য ড. সুব্রহ্মণ্যম স্বামী টুইট করে ‘শ্রীলঙ্কায় সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতা এ অঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর হবে এবং কলম্বো অনুরোধ করলে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ করা উচিত’ বলে মন্তব্য করার কারণে বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপবিষয়ক আতঙ্কটি ছড়িয়ে থাকতে পারে।
ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে ঘোষণা করেছেন, তিনি প্রতিবাদকারীদের পেছনে লুকিয়ে থাকা ‘ফ্যাসিস্টদের’ কাছে নতজানু হবেন না এবং তিনি আইনশৃঙ্খলা যন্ত্রকে প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হলেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের বিরুদ্ধে নই। তবে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা দরকার। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা দুই পুলিশ সদস্যের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে এবং ২৪ জন সেনাসদস্যকে আহত করেছে। এটি আমরা মেনে নিতে পারি না। নৈরাজ্য অর্থনৈতিক অস্থিরতার দিকে নিয়ে যাবে। কারণ, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি হলে খাদ্য, জ্বালানি এবং গ্যাসের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বিতরণ স্থবির হয়ে পড়বে।’
বিক্রমাসিংহে একক বৃহত্তম দল শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) সমর্থিত এবং সে কারণে তিনিই সামনের সারির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত তাঁকে নিয়ে স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু উদ্বেগজনক প্রশ্ন হলো: বিরোধী দল এবং পার্লামেন্টের বাইরের আন্দোলনকারীরা কি আবার আন্দোলন শুরু করবে? সহিংসতার পুনরুত্থান কি হবে না? সর্বোপরি বিক্রমাসিংহেকে বিরোধীরা এবং আন্দোলনকারীরা ঘৃণ্য রাজাপক্ষে পরিবারের একজন অনুগত দাস হিসেবে মনে করে থাকে।
রাজনীতিক শ্রেণির উদ্দেশে বিক্রমাসিংহে বলেছেন, ‘আমি সব দলকে সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য একটি সমঝোতায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ভুলে যাওয়ার সময় এসেছে। আমাদের রাজনীতিতে জড়িত থাকার জন্য একটি দেশ থাকা উচিত।
তাই আমি সব রাজনৈতিক দলকে দেশ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাই।’ ২০ জুলাই পার্লামেন্ট নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিক্রমাসিংহে এবং বিরোধীদলীয় নেতা সজিথ প্রেমাদাসা প্রধান প্রার্থী থাকছেন। প্রার্থী তালিকায় সাবেক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল শরৎ ফনসেকা এবং জনতা বিমুক্তি পেরামুনা পার্টির নেত্রী অনুরা দিসানায়েকেও রয়েছেন।
বিক্রমাসিংহে একক বৃহত্তম দল শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) সমর্থিত এবং সে কারণে তিনিই সামনের সারির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত তাঁকে নিয়ে স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু উদ্বেগজনক প্রশ্ন হলো: বিরোধী দল এবং পার্লামেন্টের বাইরের আন্দোলনকারীরা কি আবার আন্দোলন শুরু করবে? সহিংসতার পুনরুত্থান কি হবে না? সর্বোপরি বিক্রমাসিংহেকে বিরোধীরা এবং আন্দোলনকারীরা ঘৃণ্য রাজাপক্ষে পরিবারের একজন অনুগত দাস হিসেবে মনে করে থাকে।
সবার কাছে এটিই স্পষ্ট, রাজাপক্ষে পরিবারই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী ও ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। তবে বিক্রমাসিংহে শেষ পর্যন্ত রাজাপক্ষের পাঁড় অনুগত না–ও থাকতে পারেন। কারণ, শ্রীলঙ্কায় (এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে) রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখানে প্রত্যেক নেতাই গদিতে বসার সঙ্গে সঙ্গে ‘নিজের মানুষ’ হয়ে ওঠেন।
সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিক্রমাসিংহে ২০১৪ সালে মাইথ্রিপালা সিরিসেনাকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়ে ভেবেছিলেন, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা তাঁর সুরে নাচবেন। কিন্তু সিরিসেনা অচিরেই নিজেকে বিক্রমাসিংহের জন্য যন্ত্রণাদায়ক হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন।
প্রত্যেক নতুন নেতা অতীত নেতৃত্বের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্ক নেই, এমন লোকদের নিজ হাতে বাছাই করে নিজের মতো করে দল গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন। বিক্রমাসিংহে তাই করতে পারেন।
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
পি কে বালাচন্দ্রন শ্রীলঙ্কায় বসবাসরত ভারতীয় সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক