আমাদের জাদুর শহরে কত যে বিপদ, কত যে মৃত্যুফাঁদ পাতা, সেটা হয়তো একমাত্র নিয়তিই জানে। হয়তো আপনি সারা দিন অফিস শেষে যুদ্ধ করে বাসে চড়ে বাসার কাছের স্টপেজে নেমে ভাঙাচোরা ফুটপাত দিয়ে ভিড় ঠেলে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছেন।
হয়তো রাস্তার হকারের কাছে থেকে আপনার একমাত্র সন্তানের জন্য তার প্রিয় হাওয়ায় মিঠাই কিনেছেন। কিন্তু ঝড় নেই, হাওয়া নেই কোথা থেকে একটা ইটের টুকরা ঠিক আপনার মাথায় এসে পড়ল। এরপরের গল্পটা আমাদের সবার জানা।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা দীপু সানার এমন ট্র্যাজিক মৃত্যু হয়েছিল। তিন বছর বয়সী সন্তানের জন্য চকলেট নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন সানা। উদ্ধারের সময় চকলেটটি তাঁর হাতের মুঠোতে শক্ত করে ধরা ছিল। এই মৃত্যুর কি কোনো সান্ত্বনা থাকে?
শিশু জিহাদ আর ইসমাইলের ট্র্যাজেডির কথা আমরা কি ভুলে গেছি? ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে পরিত্যক্ত পানির পাইপের মধ্যে পড়ে নিখোঁজ হয়েছিল জিহাদ। ফায়ার সার্ভিস ব্যর্থ হয়েছিল শিশুটিকে উদ্ধার করতে। ২৩ ঘণ্টা পর কয়েকজন তরুণ শিশুটির নিথর দেহ তুলে এনেছিলেন। টেলিভিশন, অনলাইন আর পত্রিকার লাইভ, সারা দেশের মানুষের প্রার্থনা—সবটাই ব্যর্থ হয়। সেটা ছিল ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের ঘটনা।
ঠিক এক বছর পর সেই ডিসেম্বর মাসেই ঢাকার শ্যামপুরে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলে পড়ে মারা যায় পাঁচ বছরের শিশু ইসমাইল হোসেন। অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলার সময় ম্যানহোলের খোলা ঢাকনা দিয়ে সে পয়োনিষ্কাশনের নর্দমার ভেতরে পড়ে যায়। শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কয়েক ঘণ্টা পর নর্দমার পানিতে ভেসে যাওয়া মৃত ইসমাইলের লাশ পাওয়া যায় বুড়িগঙ্গা নদীতে।
জিহাদ, ইসমাইলের মৃত্যুর পর কত টক শো হলো, কত সেমিনার হলো, পত্রিকার পাতায় কতজন কত কলাম লিখলেন, আদালত পর্যবেক্ষণ দিলেন; কিন্তু আমরা ভুলে গেলাম। ঢাকনা খোলা ম্যানহোল যে আমাদের শিশুদের জন্য মৃত্যুফাঁদ।
রাস্তায় খোলা ম্যানহোল দেখলেই আমার স্মৃতিতে জিহাদ আর ইসমাইলের মুখ দুটি ভেসে ওঠে। আমাদের দেশে মানুষের জীবন কতটা সস্তা! এসব অবহেলাজনিত মৃত্যু, এসব কাঠামোগত হত্যার অবসানের জন্যই তো ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান।
জুলাই–আগস্ট এ ভূমির ইতিহাসে অভূতপূর্ব এক গণ–অভ্যুত্থান হয়ে গেল। ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনের সঙ্গে প্রবল বানের স্রোতের মতো সমাজের আর সব মানুষেরা তাঁদের নিজ নিজ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মিশে গেলেন। সৃষ্টি হলো অনন্য এক ঐক্য, সৃষ্টি হলো সম্মিলিত জন–আকাঙ্ক্ষা। শত শত পথ–মত ও রাজনীতির মানুষ—সবাই। সবার মধ্যে একটাই প্রত্যাশা। কেউ আর পুরোনো বাংলাদেশে ফিরবে না।
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দায়িত্ব এসে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। ১০০ দিনের মাইলফলক তারা পার করে এসেছে। মানে, সরকারের মধুচন্দ্রিমার দিন শেষ হয়ে গেছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনার মতো অর্জনের সঙ্গে ব্যর্থতার পাল্লাটাও কম ভারি নয়। ছোট ছোট অনেক কাজ যেগুলো সমাধান হলে জনভোগান্তি কমে যায়, কিন্তু রয়ে গেলে পচা শামুকে পা কাটার মতো বড় কোনো দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে, এমন দিকে কম নজর দেওয়া হচ্ছে।
এ বছর সারা দেশের মতো ঢাকায়ও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল। পানিনিষ্কাশনের সহজ সমাধান হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে দেওয়া হয়েছিল। আবার অনেক ম্যানহোলের ঢাকনা লোহার হওয়ায় সেগুলো চুরি গেছে। আবার ময়লা পরিষ্কারের জন্য ম্যানহোলের ঢাকনা সরানো হলেও সেটা আর জায়গামতো রাখা হয় না। ফলে ঢাকার অনেক জায়গায় ফুটপাত ও সড়কে অসংখ্য ম্যানহোল এখন ঢাকনা খোলা অবস্থায় রয়েছে।
বাংলামোটর থেকে মৌচাক পর্যন্ত সড়কে হাঁটতে গিয়ে আমি এ রকম ১৯টি ঢাকনা খোলা ম্যানহোল দেখতে পেয়েছি। ফুটপাতের দোকানদার, ছোট ব্যবসায়ীরা নিজেদের ও অন্যদের সুরক্ষার কথা ভেবে কোনো ম্যানহোলের মধ্যে বাঁশ দিয়ে তার মাথায় লাল কাপড় বেঁধে দিয়েছেন, কোথাও বালুর বস্তা দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন, কোথাও প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে রেখেছেন, কোনোটার পাশে আবার গাছভর্তি টব রাখা হয়েছে। বেশির ভাগ খোলা ম্যানহোলের ওপর ফুটপাতের কংক্রিট স্ল্যাব আড়াআড়ি রেখে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ম্যানহোলের ঢাকনা পুরোটাই খোলা।
ফুটপাত ও সড়ক দিয়ে প্রতিদিন অজস্র মানুষ চলাচল করেন। তাঁদের মধ্যে বৃদ্ধ ও শিশুরাও থাকে। থাকেন দৃষ্টি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষও। তাঁরা তো পা ফসকে ম্যানহোলের ভেতর পড়ে যেতে পারেন। কংক্রিটের উঁচু স্ল্যাবে হোঁচট খেতে পারেন। শিশুরাও তো খেলতে খেলতে ভেতরে পড়ে যেতে পারে।
রাস্তায় খোলা ম্যানহোল দেখলেই আমার স্মৃতিতে জিহাদ আর ইসমাইলের মুখ দুটি ভেসে ওঠে। আমাদের দেশে মানুষের জীবন কতটা সস্তা! এসব অবহেলাজনিত মৃত্যু, এসব কাঠামোগত হত্যার অবসানের জন্যই তো ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান। ভাঙাচোরা, এবড়োখেবড়ো ফুটপাতগুলো সংস্কার করা, লাঠি–বাঁশ সরিয়ে ম্যানহোলগুলোর ঢাকনা বন্ধ করে দেওয়া খুব কঠিন কাজ কি?
● মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী