চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন, যেখানে প্রযুক্তি, ডেটা ও স্বয়ংক্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের শিল্পবিপ্লব ঘটছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার ও শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিকায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস এবং বিগ ডেটার মতো প্রযুক্তি এখন শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারায় চলে আসছে। এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতখানি প্রস্তুত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার জন্য?
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে তথা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাধ্যমিক স্তরে নতুন কারিকুলামের প্রবর্তন এবং এই কারিকুলামকে সামনে রেখে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, কারিকুলাম রিফর্ম বা পরিবর্তনের আগে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে কোনো ধরনের গবেষণালব্ধ ডেটা ব্যবহারের তাগিদ কারিকুলাম–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনুধাবন করেননি।
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে যথাযথ গবেষণা, পাইলট প্রোগ্রাম এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি ছিল। ফলে প্রথম থেকেই শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা নতুন কারিকুলামকে অকার্যকর এবং দেশের চাহিদার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে অভিহিত করার চেষ্টা করেছেন। এই জন–অসন্তোষ এতই ব্যাপক ছিল যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে। এটা অনেকটাই সুনিশ্চিত যে কারিকুলাম–সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনগুলো বাস্তব অর্থে ব্যর্থ হতে চলেছে, এ কাজে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, তা রাষ্ট্রের একধরনের অপচয় হিসেবে পরিগণিত হবে।
উচ্চশিক্ষা স্তরের ক্ষেত্রে ইউজিসি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা মেটানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আউটকাম বেজড এডুকেশনের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। আউটকাম বেজড এডুকেশন মূলত একটি অত্যন্ত কার্যকর শিক্ষণ পদ্ধতি, যা শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন গভীর বিচার–বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। যদি শুধু নির্দেশনা দিয়ে এই পরিবর্তন আনা হয়, তবে এটি কার্যকর হবে না।
শুধু তা–ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি) গঠিত হয়েছে। তবে এই সেলগুলো যদি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মাবলি পূরণ করার জন্য গঠন করা হয় এবং এর কার্যকারিতা সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করা হয়, তবে তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পরিকল্পনা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার জন্য কতটা কার্যকর, আমরা কি বিচার–বিশ্লেষণ করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, নাকি এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো ট্রায়াল অ্যান্ড এরর বেসিসে পরিচালিত হবে?
ট্রায়াল অ্যান্ড এরর ভিত্তিতে পরিচালিত পরিকল্পনাগুলো দীর্ঘ মেয়াদে অপ্রত্যাশিত ফল দিতে পারে। সুতরাং, পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে গভীর চিন্তা, গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। শুধু পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেই হবে না, এর সঠিক বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন কোর্স অফারিংয়ের ক্ষেত্রে এবং চলমান কারিকুলাম রিভিশনের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের স্টেকহোল্ডারকে কতখানি কাজে লাগাচ্ছি, সে বিষয়টিও প্রশ্নসাপেক্ষ। আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারার কারণে চাহিদা ও জোগানের যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে, এই শূন্যতা আমরা কীভাবে দূর করব সে বিষয়েও আমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে চাকরিদাতাদের চাহিদা অনুযায়ী গ্র্যাজুয়েট জোগান দিতে পারছে না তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গ্রেডের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ পরীক্ষা। প্রায় ৫ হাজার পরীক্ষার্থী ওই পদের জন্য আবেদন করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো প্রার্থীকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য মনে না হওয়ায় কাউকে নিয়োগ দেয়নি।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষক এখনো প্রযুক্তির সঠিক ধারণা ও ব্যবহার সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জানেন না, যা শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার একটি বড় কারণ। চাকরির বাজারে চাহিদা ও জোগানের এই সমন্বয়হীনতা এবং পরিকল্পনাহীনতাকে পুঁজি করে আমরা কীভাবে চতুর্থ বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তির কথা বিবেচনা করছি, তা বোধগম্য নয়।
উন্নত বিশ্বে মূলধারা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পরবর্তী সময়ে চাকরির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা কোর্সের প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের আরও উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ নেই বললেই চলে।
এ ধরনের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে যেকোনো মানুষ যেকোনো বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলধারায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। অথচ আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিকের পরে শুধু একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বয়সী লোকদের শিক্ষার মূলধারায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ রহিত করা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে ইভিনিং প্রোগ্রামের আওতায় বিভিন্ন কোর্স অফার করা হচ্ছে। এসব কোর্সের গুণগত মান এবং বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। তাই দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য আমাদের দরকার ইউনিভার্সিটি ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সুসমন্বয়। গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্র্যাজুয়েটরা কোন ধরনের দক্ষতাগুলো শিল্পক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পেরেছে আর নতুন করে কোন ধরনের যোগ্যতার চাহিদা তৈরি হচ্ছে, তা যাচাই করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য অ্যালামনাইদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শুধু স্বপ্নবিলাসী সম্ভাবনার দিবাস্বপ্ন না দেখে আমাদের উচিত হবে কার্যকর ও সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং চাকরিদাতাদের সুসমন্বয়ের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ গ্র্যাজুয়েট সরবরাহে মনোযোগী হওয়া। সর্বোপরি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলামকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, যাতে গার্মেন্টস সেক্টরসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা শিক্ষার্থীরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ও ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। এ জন্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী স্কিল নির্ধারণ করে শিক্ষার নিম্নতর স্তর থেকে শুরু করে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত কারিকুলাম এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকর পরিবর্তন অত্যাবশ্যক।
এ ধরনের গুণগত পরিবর্তনকে বিচ্ছিন্ন উপাদান হিসেবে না দেখে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, অন্যথায় কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত নাও হতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রমে প্রযুক্তি সংযুক্তকরণ, শিক্ষকদের কার্যকর প্রশিক্ষণ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথকে ত্বরান্বিত করতে পারে। সরকারের উচিত এই বিষয়ে আরও বিনিয়োগ করা এবং একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যাতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারে এবং দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথকে সুগম করতে পারে।
সাব্বির আহমেদ চৌধুরী সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]