যে সমাজ শিক্ষককে সম্মান দেয় না, যে রাষ্ট্র শিক্ষকের সম্মান রক্ষা করতে পারে না, সেখানে শিক্ষার দুরবস্থাই বাস্তবতা। বাংলাদেশে শিক্ষার এই দুরবস্থা এক দিনে হয়নি। আমাদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে সমাজের অবক্ষয় ঘটেছে ও শিক্ষার অবনতি হয়েছে।
কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষকদের হেনস্তার যেসব ঘটনা ঘটছে, তার কিছু সামাজিক অবক্ষয়ের পরিণতি আর কিছু রাজনীতিতে ও সমাজে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের প্রতিফলন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের হেনস্তার যেসব ঘটনা ঘটছে, তা সামাজিক অবক্ষয়ের ফল হলেও স্কুল–কলেজের কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেসব ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে, তার সাম্প্রদায়িক চরিত্র ঢাকা থাকেনি।
নড়াইলের সর্বশেষ ঘটনা নিয়ে কথা বলার আগে সেখানকার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের অধ্যক্ষের চরম অবমাননার প্রসঙ্গে কিছু বলা দরকার। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকদের যে তিনটি মোটরসাইকেল সেদিন পোড়ানো হয়েছিল, সেগুলো ছিল সংখ্যালঘু শিক্ষকদের। সেগুলোর সঙ্গে এক মুসলিম শিক্ষকেরও একটি মোটরসাইকেল ছিল। কিন্তু আগুন দেওয়ার আগে সেটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেয় দুষ্কৃতকারীরাই। এতে ঘটনার পেছনে সাম্প্রদায়িক দুষ্টবুদ্ধি ও ধর্মান্ধতা কাজ করেছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না।
গত বছর দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কোরআন রেখে অবমাননার যে অভিযোগ উঠেছিল, তার পেছনে এক মুসলিম দুষ্কৃতির ভূমিকা তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল। পুলিশি তদন্তে বোঝা গিয়েছিল, অভিযুক্ত ব্যক্তি এ কাজে একা ছিলেন না। এই এক ঘটনার জেরে দেশের আরও নানা স্থানে পূজামণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছিল, প্রাণহানিও ঘটেছে।
কিন্তু কই, এ নিয়ে মামলা কি এগোচ্ছে? সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে বিচারের বাণী বরাবর নীরবে নিভৃতেই কেঁদে মরে। কিন্তু এর খেসারত সমাজ দিচ্ছে, রাষ্ট্রও দিচ্ছে। বাংলাদেশের সমাজে সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ দেশে শিক্ষকতা পেশায়, বিশেষত স্কুল ও কলেজে ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষিতজনের অংশগ্রহণ যথেষ্ট।
একসময় দক্ষ, যোগ্য, খ্যাতিমান শিক্ষকদের সিংহভাগই ছিলেন এই সম্প্রদায়ের মানুষ। এখনো তাঁদের কিছু প্রতিনিধি এ পেশায় মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত আছেন। বিভিন্ন ঘটনায় মনে হচ্ছে, একটি মহল সমাজে তাঁদের এই শক্ত অবস্থানকে নড়বড়ে করে দিতে চাইছে।
রাষ্ট্র এর কী প্রতিকার করছে? মামলা ও বিচারের পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে মিটিয়ে দিতে চেয়েছে। বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সে ঘটনায় যেমন ঘটনাস্থলে অনেকের ভূমিকা ছিল, তেমনি আবার নেপথ্যেও উসকানির মানুষের অভাব ছিল না।
একই সঙ্গে এ কথাও না বললেই নয়, শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সঠিক ধারা ফেরাতে হলে রাজনীতি ও প্রশাসনকেও তো সঠিক চেতনায় ফেরাতে হবে। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার চর্চা বজায় রেখে বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষা ও শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি গুণগত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব? অতএব দিনে দিনে অনেক বকেয়া কাজ জমে গেছে। উন্নয়নের নেশায় আর ক্ষমতার মোহে সমাজ গঠন ও সামাজিক প্রগতি যে জরুরি বিষয়, তা যেন ক্ষমতাসীন মহল ভুলে গেছে।
তাঁর তাৎক্ষণিক জামিন না হয়ে কারাবাস সে ইঙ্গিত দেয়। আর অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের ঘটনায় একজন শিক্ষকের চরম অবমাননা বন্ধে খোদ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের অকার্যকর থাকা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। ঘটনার প্রত্যক্ষ ও নেপথ্য নায়কেরা কতটা শক্তিশালী হলে পুলিশ সুপার হিন্দু হয়েও কোনো ভূমিকা নেন না, সেটা ভেবে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না!
অস্বীকার করা যাবে না যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ক্ষমতাবান দলের বিভিন্ন স্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রেই সক্রিয় রয়েছে। তাই সরকারের উচ্চ মহলের কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও মাঠে তার প্রতিফলন ঘটে না।
নড়াইলের সর্বশেষ ঘটনায় রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ অপরাধীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই কারা আইন হাতে তুলে নিয়ে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতে হামলা করেছে ও আগুন দিয়েছে, তার তদন্ত জরুরি। আমরা বলব, এলাকার সংসদ সদস্য ও দেশের ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব মাশরাফি বিন মুর্তজা যেভাবে সরব হয়েছেন, তাৎক্ষণিক সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন, তা ভুক্তভোগীদের মনে সাহস জোগাবে। এমন ভূমিকা সর্বত্র কাম্য হলেও তা দেখা যায় না, এটাই সত্য।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে অনেক কথাই আলোচিত হয়ে থাকে। সরকার নানাভাবে মানসম্পন্ন শিক্ষার চাহিদা পূরণে সচেষ্ট, কিন্তু শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় কোনো রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরং শিক্ষকদের সরকারি ও বেসরকারি বহু রকম কর্তৃপক্ষের অধীন করেছে, যাদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। অনেক সময় শিক্ষকেরা এদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে থাকেন।
রাজশাহীতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের হাতে একটি কলেজের অধ্যক্ষের লাঞ্ছনার অভিযোগের নিষ্পত্তি যে পথে হয়েছে, তাতে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নাকি শক্তির কাছে আইন ও ন্যায়ের পরাজয় ঘটল, সেটাই জিজ্ঞাস্য থেকে গেল। এ ধরনের ঘটনার সামান্যই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং কোনোটিরই বিচার হয় না।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, আজকের দিনে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সহশিক্ষা কার্যক্রম হয় না। সমাজে কিশোর ও তরুণদের খেলাধুলার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই বয়সে সুস্থ বিনোদনের অভাব ঘটলে তারা যে বিপথগামী হতে পারে, সেটা নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।
আজকের দিনে বিভিন্ন রকম নেশাদ্রব্য, অশ্লীল চলচ্চিত্র, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিবাদ এবং নানা রকম দলবদ্ধ সহিংসতাচর্চার পথ খুলে গেছে। দুঃখের সঙ্গে এ–ও বলতে হবে যে আজকের রাজনীতি কিশোর-তরুণদের সঠিক পথ দেখাতে সম্পূর্ণ অপারগ। একই সঙ্গে সমাজে, পরিবারে বাড়ছে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা। অনেক পরিবার থেকেই সন্তানদের অন্য ধর্মের সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশায় বিরত থাকার ‘উপদেশ’ দেওয়া হয়।
অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়কে হেয় করা, সমালোচনা করাও অনেকের ব্যক্তিগত আচরণে ও পারিবারিক সংস্কৃতিতে অঙ্গীভূত হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই একটি সমাজ নিজের অজান্তে সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়। বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ এবং হাজী ইউনুস আলী স্কুল ও কলেজের যেসব ছাত্র ও অভিভাবক শিক্ষককে অসম্মানিত করার বিকৃত কাজে অংশ নিয়েছেন বা তা ঠেকাতে কাজ করেননি, তাঁরা অবশ্যই একটি সাম্প্রদায়িক সমাজেরই ফসল। সঠিক সমাজ গঠন ও বিদ্যার সঠিক ধারা বাস্তবায়নে বিলম্ব বা দ্বিধা করলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিকৃত ঘটনা ঠেকানো যাবে না। সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগও থামানো যাবে না।
এ বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় যে বাঙালির চিরায়ত মানবতাবাদী সমাজের পতনের সূচনা পঁচাত্তরের পর শুরু হলেও তার দুর্ভাগ্যজনক পরিসমাপ্তি যেন ঘটছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির উদ্গাতা ও স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের শাসনামলে। আর এসব ঘটছে উদার মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষায় সর্বধর্মের মানুষের ত্যাগে ও অবদানে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই বাংলাদেশে। প্রশ্ন তোলা যায়, এ বাস্তবতায় কে পরাজিত হচ্ছে—বাঙালি, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ? এমনকি এ প্রশ্নও তোলা যাবে, ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি কি পরাজিত হচ্ছে না?
দেখা যাচ্ছে, সুস্থ বিনোদনের অভাবে কিশোর-তরুণদের অনেকেই কখনো নিজেই, আবার কখনো কারও দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাচ্ছেন। যেকোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রশাসনের দায়িত্ব। তবে এতেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হবে না। কিশোর-তরুণদের জন্য সুস্থ বিনোদনচর্চার পরিবেশ সমাজে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য মেগা প্রকল্প প্রয়োজন হলে তা–ও নিতে হবে। কেননা এই কিশোর-তরুণেরাই জাতির ভবিষ্যৎ, আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিক। তাঁদের নৈতিক ও মেধাগত চিন্তা ও রুচির ঘাটতি নিয়ে বড় হতে দিলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
একই সঙ্গে এ কথাও না বললেই নয়, শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সঠিক ধারা ফেরাতে হলে রাজনীতি ও প্রশাসনকেও তো সঠিক চেতনায় ফেরাতে হবে। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার চর্চা বজায় রেখে বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষা ও শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি গুণগত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব? অতএব দিনে দিনে অনেক বকেয়া কাজ জমে গেছে। উন্নয়নের নেশায় আর ক্ষমতার মোহে সমাজ গঠন ও সামাজিক প্রগতি যে জরুরি বিষয়, তা যেন ক্ষমতাসীন মহল ভুলে গেছে।
সেই রন্ধ্র দিয়ে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার কালসাপ প্রবেশ করছে সমাজে। তার পরিণতি কী হতে পারে, তা নিশ্চয়ই পঁচাত্তরের প্রত্যাঘাতের ঘটনায় আমাদের অজানা নেই। তাই বলব, সময় থাকতে সাবধান হওয়া দরকার। সাধু সাবধান!
আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক