বর্তমান নির্বাচন কমিশন বেশ কৌশলী। আগের দুটি কমিশন ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য চাপ ও প্রত্যাশা পূরণ করে বিতর্কিত হয়েছে। কিন্তু তাদের গঠনপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছিল। এবার কমিশন গঠিত হয়েছে হঠাৎ তৈরি হওয়া এক আইনে, কিন্তু এর মনোনয়নপ্রক্রিয়া ছিল বর্জনপীড়িত। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল যাদের প্রতিপক্ষ মনে করে, সেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় অর্ধেকই মনোনয়নপ্রক্রিয়া বর্জন করেছিল। ফলে সরকারের সুবিধাভোগী ও পছন্দের আমলাদের নিয়ে গঠিত কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন শুরুতেই নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার কৌশল গ্রহণ করেছে। এই কমিশন মাস চারেকের কম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে দুই দফা আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী মাসে তারাই সব দলকে তৃতীয় দফা আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে বলে খবর বেরিয়েছে।
তবে গত দুই দফাতেই তাদের আমন্ত্রণে অর্ধেকের মতো দল সাড়া দেয়নি। প্রথম দফায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পরীক্ষা করার আমন্ত্রণ আর দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ গ্রহণ। এখন বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তারা যে তিন শতাধিক সুপারিশ পেয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে নিজেরা একটি কৌশলপত্র তৈরি করবে। আর সেই কৌশলপত্র নিয়ে সব দলকে একত্র করে আলোচনার আয়োজনের সম্ভাবনার কথা তারা বলেছে।
কমিশন একটি সর্বদলীয় সংলাপের আয়োজন করলে কী দাঁড়াবে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের দুই দফা মতবিনিময় নিঃসন্দেহে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং তা নিয়ে প্রচুর আলোচনাও চলছে। জনপরিসরে সমালোচনায় কমিশন কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবে, তা বলা মুশকিল। তবে কয়েকটি রাজনৈতিক দল যে একটু একটু করে অগ্রসর হয়েছে, সে কথা মানতেই হবে। সংবাদমাধ্যমে যাদের বিবৃতি কখনো স্থান পায় না, সেসব দলও কমিশনের আলোচনায় এসে চটকদার প্রস্তাব দিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। তবে নির্বাচনের প্রধান প্রতিপক্ষ যদি এ প্রক্রিয়ায় অংশ না নেয়, তাহলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন আদৌ সম্ভব নয়, সে কথা অস্বীকার করা যাবে না।
যে মেশিনে ভোট পুনর্গণনার সুযোগ নেই, সে রকম একটি ত্রুটিপূর্ণ মেশিন যারা তৈরি ও সরবরাহ করেছে, তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে চাইতেই পারে যে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হোক। কিন্তু সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের অতি উৎসাহের কারণ কী? তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য আমলারা নির্বাচনের ফলাফল যা-ই দিন না কেন, সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হওয়ার সুবিধা আদায়ই কি ইভিএমের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণ নয়?
ইভিএম নিয়ে মতবিনিময় এবং নির্বাচনের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সংলাপ—উভয় পর্বেই মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছে যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অবস্থান তার জোটসঙ্গীদের কয়েকটি দল ছাড়া আর কেউ সমর্থন করছে না। অন্য কথায়, জোটসঙ্গীরাও সবাই সমর্থন করছে না; যদিও ধারণা করা অন্যায় হবে না যে সাম্যবাদী দল বা ওয়ার্কার্স পার্টির মতো জোট শরিকেরা মন্ত্রিত্ব ফিরে পেলে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে তাদের আর কোনো মতভিন্নতা থাকবে না। তারা যে নির্বাচনকালে কয়েকটি মন্ত্রণালয় কমিশনের অধীন করার কথা বলেছে, তার সাংবিধানিক ভিত্তি কী? মন্ত্রীরা যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কাছে, মতান্তরে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য, সেহেতু নির্বাচন কমিশনও তো তখন প্রধানমন্ত্রীর অধীন অন্যান্য দপ্তরের মতোই নির্বাহী কর্তৃত্বের অনুগত হতে বাধ্য। আর যদি এ জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তাহলে তো তা সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই ফিরিয়ে আনা যায়।
সংলাপে অংশ নেওয়া এবং বর্জনকারী মিলে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন সরকারে যে ধরনের পরিবর্তন চায়, তার মধ্যেও হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, মোট ১৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল (সংলাপে যাওয়া ১০টি + বর্জনকারী ৯টি) নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের কথা বলছে। নির্বাচনের সময় সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে ইসির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছে ১২টি দল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী, অর্থাৎ তার তৈরি করা ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে এখন পর্যন্ত অনড়। বিদ্যমান ব্যবস্থাটি যে আওয়ামী লীগের তৈরি করা, তা বোঝার জন্য স্মরণ করা দরকার যে সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশের আগেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করা হয়, যদিও রায় লেখার আগে মৌখিক আদেশে আদালত দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যদের দ্বিতীয় যে বিষয়ে বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে, তা হলো ইভিএমে ভোট গ্রহণের প্রশ্ন। ইভিএম যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, সে কথা প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন। যে মেশিনে ভোট পুনর্গণনার সুযোগ নেই, সে রকম একটি ত্রুটিপূর্ণ মেশিন যারা তৈরি ও সরবরাহ করেছে, তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে চাইতেই পারে যে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হোক। কিন্তু সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের অতি উৎসাহের কারণ কী? তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য আমলারা নির্বাচনের ফলাফল যা-ই দিন না কেন, সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হওয়ার সুবিধা আদায়ই কি ইভিএমের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণ নয়?
নির্বাচন কমিশনের সংলাপে আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যদের আরও একটি বিষয়েও মতভেদ স্পষ্ট হয়েছে। এ মতভেদ হচ্ছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে। ভোটারদের ভোটের অধিকারবঞ্চিত করা নির্বাচন দুটি যে গণতন্ত্রসম্মত হয়নি, সে কথা এখন ওই অন্যায় কাজের সহযোগীরাও কমিশনে গিয়ে স্বীকার করে এসেছেন, যেটা সাধারণত রাজসাক্ষীরা করে থাকেন। ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানোর সুপারিশ করতে গিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটা (ভোট দেওয়া) হয়। হয় মানে কী, আমরাই করাইছি, কী বলব, এটা হয়।’ আর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার শরিক সাম্যবাদী দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়া সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন, মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ চায়। ১৪-দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল মানুষের ভোটাধিকার আদায়ের জন্য। সেটাই যদি না থাকে, তাহলে রাজনীতি করে কী লাভ (সমকাল, ৩১ জুলাই ২০২২)!
এসব সংলাপে কমিশন নিজেও যেসব স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তা-ও কম মূল্যবান নয়। বন্দুক তুলে নেওয়ার মতো উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তাকে কৌতুক হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে লঘু করার চেষ্টা যে কমিশনের মর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, তা মেনে নিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা যে অপরিহার্য, সে কথা মেনে নিয়েছেন। যার মানে হচ্ছে, তাঁদের সংলাপ-নাটক যে অর্থহীন, সেটা তাঁরা মেনেই নিয়েছেন। জাতীয় সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন কেমন হতে পারে, তার একটি মহড়া তাঁরা কুমিল্লার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখেছেন। ফলে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলগুলো কেন তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে, সেটাও তাঁদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। মেরুদণ্ডের প্রয়োজনীয়তার কথাও সিইসি আউয়াল মেনে নিয়ে দাবি করেছেন, সেটা নাকি যথাস্থানেই আছে। ২০১৩ সালে একজন কমিশনার ক্যামেরার সামনে শালীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর শিরদাঁড়া আছে বলে দাবি করলেও তা যে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল, সেটি আমরা সবাই দেখেছি। বর্তমান কমিশন যে তড়িঘড়ি করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করে ফেলেছে, তাতে কিন্তু আলামত একই রকম মনে হয়।
সিইসি আউয়াল গত ১৯ জুলাই আরেকটি স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) কোটি কোটি ভুল। তবে আমরা সংশোধনের চেষ্টা করছি।’ আমরা বিভিন্ন সময়ে শুনেছি, স্মার্ট কার্ড থাকার পরও আঙুলের ছাপ না মেলায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেকে ভোট দিতে পারেননি। পরিচয়পত্রের ভুলের কারণে ভবিষ্যতে কত ভোটার ভোট দিতে পারবেন না, তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। এসব ভুল যতটা না ভোটারের, তার চেয়ে বেশি কমিশনের কর্মী ও কর্তাদের, যাঁরা নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। বানান ভুল, জন্মস্থান সুনামগঞ্জের বদলে ভেনেজুয়েলা লেখা, পোস্ট কোড না থাকার মতো ভুলগুলো সংশোধনে হয়রানির সীমা নেই। এ জন্য ভোটারকে কেন ফি দিতে হবে? জন্মসনদ, বাসস্থানের ঠিকানা প্রমাণসহ নথিপত্রের চাহিদার শেষ নেই। অথচ আইরিশ, আঙুলের ছাপ, পাসপোর্ট বা সাধারণ জাতীয় পরিচয়পত্রের যেকোনো দুটি যাচাই করে স্মার্ট কার্ডের ভুল সহজেই সংশোধন করা যায়। নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার দায়িত্বটা সরকার ও দলগুলোর বলে যখন তাঁরা মেনেই নিয়েছেন, তখন বর্তমান কমিশনের উচিত হবে সেটি হওয়ার আগে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অন্তত ভোটারদের পরিচয়পত্র সংশোধনের কাজটি ঠিকভাবে করে দেখানো।
● কামাল আহমেদ সাংবাদিক