কথায় বলে, ‘সর্ব অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা’। একটি দেশের যখন সবখানে সমস্যা থাকে, তখন তা থেকে উত্তরণের উপায় বের করা দুঃসাধ্য বটে। দেশের সেবামূলক সব কটি খাত এখন দারুণ দুর্দশায় নিমজ্জিত। যে জায়গাগুলোতে কোনো রকম অনিয়ম আর দুর্নীতি হওয়ার কথা ছিল না, সেখানেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি। খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা—মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের এই তিন জায়গাকে আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরও ঠিক করতে পারিনি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এই ব্যর্থতা ভয়াবহ। আমাদের খাদ্য ও পানীয়ে ভেজাল।
দুনিয়াতে খাদ্যদ্রব্যে এত ভেজাল আর কোনো জাতি মেশায় কি না, তা আমার জানা নেই। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বেকারি থেকে শুরু করে মুদিখানা, কাঁচাবাজার—কোনো জায়গা থেকেই নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও ভয়াবহ সময় পার করছে এখন। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পড়ালেখা ও পরীক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু সার্টিফিকেট-বাণিজ্য করে, এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো। লাখ লাখ ছেলেমেয়ের সর্বনাশ করছে তারা। হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের জন্য নতুন নতুন ফন্দি-ফিকির বের করছে প্রতিনিয়ত।
সেবামূলক খাতের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সম্ভবত চিকিৎসা খাতে। সরকারি-বেসরকারি দুই জায়গাতেই এখানে চূড়ান্ত অনিয়ম। বাংলাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন, এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হয় চিকিৎসাসেবা খারাপ, চিকিৎসকের অত সময় থাকে না ঠিকভাবে রোগের বিবরণ শোনার; নয়তো হাসপাতালের পাওনা মেটাতে পকেট গড়ের মাঠ হয়ে যায়। এখানকার চিকিৎসাব্যবস্থায় আস্থা না থাকার কারণে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ পাশের দেশ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করান। আর উচ্চবিত্তদের জন্য যেসব হাসপাতাল—সেগুলো হাতে গোনা—সেখানে যাওয়ার কথা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা কল্পনাও করেন না।
সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের অনেক পদক্ষেপের কথা শোনা যায়, কিন্তু সেগুলো থেকে যে পরিমাণ সুবিধা পাওয়ার কথা সাধারণ মানুষের, সেই পরিমাণ সুবিধা তাঁরা পান না। কেননা, দায়িত্ব অবহেলার পাশাপাশি গৃহীত পদক্ষেপগুলো প্রায়ই জনসাধারণের কথা মাথায় রেখে নেওয়া হয় না, নেওয়া হয় সুবিধাভোগী ও প্রভাবশালীদের কী কী লাভ হবে, সেগুলো মাথায় রেখে। ফলে পুরো বিষয়টি একধরনের ‘সিস্টেম লস’-এর মধ্যে পড়ে যায়। সাধারণ মানুষের কাজে লাগে না, এমন ২৩৩টি স্থাপনার খবর সম্প্রতি এসেছে প্রথম আলোর খবরে। সেখানে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অপরিকল্পিতভাবে কোটি কোটি টাকার স্থাপনা তৈরি করেছে, যা আদতে কারও কোনো কাজে আসছে না। ধামরাই উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে ৩ একর জমির ওপর ২০০৬ সালে ৬টি দোতলা ভবন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতালে কোনো দিন কোনো রোগী ভর্তি হননি। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, বরগুনা, কুমিল্লাসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় এমন আরও অনেক হাসপাতাল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, যেগুলো কোনো কাজে লাগে না। কোথাও চিকিৎসক থাকে না, কোথাও যন্ত্রপাতি নেই, কোথাও আসবাব নেই, কোথাও রোগী নেই। শুধু বিপুল অর্থ অপচয়ের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাঁকা দালানগুলো।
বর্তমানে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসক ও জনসংখ্যার অনুপাত ১: ৬৫৭৯; অর্থাৎ সরকারি স্বাস্থ্যসেবার জায়গাগুলোতে ৬ হাজার ৫৭৯ জনের বিপরীতে ডাক্তার আছেন মাত্র ১ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ১ হাজার জনে কমপক্ষে ১ জন ডাক্তার থাকা উচিত যেকোনো দেশে। যে দেশে হাসপাতালগুলোতে ঘুরে ঘুরে হয়রান অসহায় রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পান না, যে দেশে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যের অভাবে মায়েরা ফুটপাতে বাচ্চার জন্ম দেন; সেই দেশে এমন স্থাপনা পড়ে থাকা, এত বিপুল টাকা অপচয় করাকে কোন স্তরের বিলাসিতা বলা উচিত, তা আমার জানা নেই।
মুন্সিগঞ্জের জেলা হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার, কিন্তু সেটা চলছে ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এখানে যাঁরা সেবা নিতে আসেন, তাঁদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। সবাইকে সেবা দেওয়াও যায় না। সেবার মানও খারাপ থাকে। কয়েকটি বিভাগে চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের বেসরকারি ক্লিনিক অথবা ঢাকায় যেতে হয় চিকিৎসা নিতে।
শুধু মুন্সিগঞ্জ সদর নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গার চিত্র মোটামুটি একই। সরকারি হাসপাতালগুলোর সমস্যার কথা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতি পদে পদে সেখানে সিন্ডিকেট আর দুর্নীতি। গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষসহ অনেক চিকিৎসক সেখানকার অসাধু চক্রের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় নামেন, মানববন্ধন করেন। তাঁরা বলেন, একশ্রেণির অসাধু কর্মচারীর সিন্ডিকেটের কারণে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জিম্মি হয়ে পড়ছেন। চিকিৎসকদের যেখানে রাস্তায় নামতে হয়, সেখানে রোগীদের কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। এমন সিন্ডিকেট বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায়। অথচ নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ নেই। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
মানুষকে জিম্মি করাই যখন বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালের স্বাভাবিক চিত্র, সেই জায়গাতে মকছেদুল মোমিনের এমন উদ্যোগ আমাদের আশার আলো দেখায়। নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়া আমাদের সেবা খাতগুলোতে এমন মকছেদুল মোমিনদের প্রয়োজন এখন সবচেয়ে বেশি।
চিকিৎসাব্যবস্থার অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গত বছরের ৩১ অক্টোবর অনশনে বসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। ওষুধ চুরি থেকে শুরু করে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ—মোটকথা, সব ধরনের দুর্নীতি দেখতে হলে সরকারি হাসপাতালগুলো একটা ভালো জায়গা হতে পারে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার এমন দশার কারণে স্বভাবতই মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ছোটেন। কিন্তু সেখানকার চিত্রও ভয়াবহ। বেসরকারি হাসপাতালের মালিকেরা যেহেতু জানেন সরকারি হাসপাতালের সেবার মান খুব খারাপ, সেখানে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার চেয়ে লটারি জেতা সহজ—তাঁরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শহরগুলোর অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা এসব হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স, সরঞ্জাম না থাকার পরও মানুষ এসব জায়গায় যাচ্ছেন। কেননা সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আইসিডিডিআরবি ২০১৯-২০ সালে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ওপর এক গবেষণা চালায়। সেখানে দেখা যায়, দেশে মাত্র ৬ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স আছে এবং দেশের মোট হাসপাতালের ৮০ শতাংশই বেসরকারি হাসপাতাল। ওই গবেষণায় দেখা যায়, হাসপাতাল হওয়ার জন্য ন্যূনতম শর্তও সেগুলো পূরণ করে না।
দেশে স্বাস্থ্যসেবার এমন অস্বাস্থ্যকর দশার মধ্যে তাই আশার আলো হয়ে ওঠে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। একজন মানুষের একক উদ্যোগে পাল্টে গেছে এ হাসপাতালের চিত্র। কয়েক বছর আগেও ময়লা-আবর্জনা ও মেডিকেল বর্জ্যের দুর্গন্ধে হাসপাতালটিতে টেকা ছিল দায়। দিনে গরু-ছাগল চড়ে বেড়াত হাসপাতালের ভেতরের চৌহদ্দিতে। রাতে মাদকসেবীরা আড্ডা বসাত। চিকিৎসক-নার্সরা বেশি দিন থাকতে চাইতেন না সরকারি এই হাসপাতালে। ফলে সাধারণ মানুষ এখান থেকে কোনো সেবা পেতেন না।
কিন্তু এখন বদলে গেছে পুরো হাসপাতালের চিত্র ও চরিত্র। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে এখন ঝকঝকে। সবুজে ছেয়ে গেছে চারপাশ। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে পাঠাগার। চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মচারী আগে এখানে থাকতে চাইতেন না। কিন্তু তাঁদের আবাসন ও অন্যান্য সমস্যা দূর করা হয়েছে। এখন তাঁরা এ হাসপাতালে একবার বদলি হয়ে এলে এখান থেকে আর যেতে চান না। বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে এই চিত্র নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী।
প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থা থেকে হাসপাতালটিকে এ অবস্থায় নিয়ে এসেছেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মকছেদুল মোমিন। কিন্তু এখনো ৩১ শয্যার জনবল নিয়ে চলছে ৫০ শয্যার এ হাসপাতাল। ফলে কিছু জায়গায় সংকট রয়ে গেছে। সংকট থাকা সত্ত্বেও যে পরিবর্তন সম্ভব, তা দেখিয়ে দিয়েছেন মকছেদুল মোমিন। তাঁর আন্তরিকতা ও সেবা দেওয়ার মানসিকতা অন্যান্য হাসপাতাল থেকে এ হাসপাতালকে আলাদা করেছে। এখন প্রচুর মানুষ এখানে সেবা নিতে আসেন।
মানুষকে জিম্মি করাই যখন বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালের স্বাভাবিক চিত্র, সেই জায়গাতে মকছেদুল মোমিনের এমন উদ্যোগ আমাদের আশার আলো দেখায়। নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়া আমাদের সেবা খাতগুলোতে এমন মকছেদুল মোমিনদের প্রয়োজন এখন সবচেয়ে বেশি।
মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক
[email protected]