ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে চিনি কমবেশি এক যুগ ধরে। আমরা থাকি কাছাকাছি, আমাদের দুই বাসার দূরত্ব আধা কিলোমিটারের মতো। একে অপরের বাসায় যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। সেই বাসায় গেলে প্রথমেই জুটত তেঁতুলের শরবত, কাঁচা আমের শরবত অথবা ঋতুভেদে কোনো ফলের পানীয়। বসার ঘরে এসি নেই, দরজা-জানালা সব খোলা। বহু যুগের পুরোনো ফ্যান ঘুরছে।
পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। দেখা হলেই শিরীন (জাফরুল্লাহ ভাইয়ের স্ত্রী) প্রায়ই বলতেন যে জাফরুল্লাহ ভাইয়ের কিডনির অবস্থা ভালো না। দিন দিন খারাপ হচ্ছে। পরের এক দেখায় জানালেন যে ডায়ালাইসিস শুরু করতে হবে। ডায়ালাইসিস শুরু হওয়ার মাস দুই পরের কথা—বেশ রাতে তাঁরা দুজন আমার বাসায় এলেন।
একটু পরেই ডায়ালাইসিস নিয়ে কথা, প্রতিবার ডায়ালাইসিসের জন্য কত টাকা লাগে, সেটা আমি জানি কি না? একটু ধারণা ছিল, তাই বললাম হাসপাতালভেদে প্রতিবারের জন্য ৬ থেকে ২০ হাজার টাকা। তিনি জানালেন, আমার উত্তর সঠিক ছিল।
এরপর শিরীনের পালা। ডায়ালাইসিস করতে দু–তিন ঘণ্টা বিছানায় শুয়ে থাকা লাগে। জাফরুল্লাহ ভাইয়ের প্রথমবারের ডায়ালাইসিসের সময় তাঁর পাশের বিছানায় ডায়ালাইসিস হচ্ছিল না একজন মধ্যবয়সী নারীর। কিছুক্ষণ পরে জাফরুল্লাহ ভাই তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। সেই নারী এসেছিলেন ফরিদপুর থেকে। দুজনেরই ডায়ালাইসিস শেষ হচ্ছিল মোটামুটি একই সময়ে। শেষের দিকে জাফরুল্লাহ ভাই কথায় কথায় জানতে চাইলেন, সেই নারী ডায়ালাইসিসের জন্য আবার কখন আসবেন। এই প্রশ্ন শুনে নারীটি অনেকক্ষণ চুপ করেছিলেন। জাফরুল্লাহ ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত বললেন যে অল্প টাকায় চাকরি করা তাঁর ছেলেটি ডায়ালাইসিসের জন্য আবার যখন প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারবে, তখন তিনি আবার আসবেন।
শিরীন বললেন, ওই প্রথমবারের ডায়ালাইসিস থেকে বেরিয়ে জাফরুল্লাহ কেঁদেছিলেন। শিরীন ভেবেছিলেন যে ডায়ালাইসিসে বোধ হয় ব্যথা হয়েছিল বা শারীরিক কোনো ভীষণ অসুবিধা, তাই চোখে জল। ওই দিন রাতে জাফরুল্লাহ ভাই শিরীনকে সেই ফরিদপুরের নারীর কথা জানিয়েছিলেন। তখন শিরীন বুঝেছিলেন যে অশ্রুর কারণ ছিল সেই নারীটির দুঃখ।
সারা জীবনই উল্টো ধারার মানুষ ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সবাই বলে চিকিৎসক হওয়ার জন্য অনেক শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা দরকার। জাফরুল্লাহ ভাই মনে করতেন, এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের সাধারণ রোগবালাই দূর করতে চিকিৎসাশাস্ত্রের ডিগ্রির দরকার নেই। অল্প কিছু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দৈনন্দিন বেশির ভাগ রোগবালাইয়ের সুচিকিৎসা সম্ভব।
আরেক দিনের আড্ডার সাক্ষাতে জাফরুল্লাহ ভাই আমাকে ডায়ালাইসিসের বিভিন্ন দিক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। যে মূল কথাটি বুঝেছিলাম, তা হচ্ছে—করাচির একটা এনজিও হাসপাতালে ১ হাজার ২০০ টাকায় ডায়ালাইসিস হয়। মুম্বাইতেও গরিব রোগীদের জন্য হাজার–বারো শ টাকায় ডায়ালাইসিস হয়। আমাকে হিসাব করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে প্রতিবার ডায়ালাইসিসের জন্য কিছু নল লাগে, ওষুধ লাগে এবং আরও লাগে সামান্য কিছু আনুষঙ্গিক সামগ্রী। সর্বসাকল্যে খরচ এক হাজার টাকার বেশি হবে না। খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ঢাকায় হাজার টাকার কমে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করব। অবশ্য এটাও বলেছিলেন যে ডায়ালাইসিসের যন্ত্রপাতি বা মেশিন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে প্রথমে খরচ লাগবে বেশ কয়েক কোটি টাকা।
পরের দেখাগুলোয় জানিয়েছিলেন যে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা চলছে। সেই সময়ে সরকারের বা ক্ষমতাসীন কারও সঙ্গে যেন তাঁর ঠোকাঠুকি চলছিল। জানলাম, তাঁর দু–তিনজন সম্ভাব্য দাতা ভয়ে পিছপা হয়ে গিয়েছিল। পাছে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাসপাতালের জন্য টাকা দিয়ে তাঁদের কোনো ক্ষতি হয়। কেউ কেউ বেনামিতে টাকা দিয়েছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় কয়েক কোটি টাকা জোগাড় হয়ে গিয়েছিল।
পরের কাহিনি আমরা সবাই জানি। ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু হলো। জাফরুল্লাহ ভাই রোগী। এখন টাকার অঙ্কের হেরফের হয়েছে কি না বলতে পারব না। কিন্তু শুরুতে ছিল ডায়ালাইসিসের জন্য তিন ধরনের চার্জ। শূন্য টাকা, দেড় হাজার টাকা ও তিন হাজার টাকা। যঁার আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত সীমিত, তাঁদের জন্য বিনা খরচে; কম আয়ের রোগীদের জন্য দেড় হাজার টাকা আর সচ্ছল রোগীর বেলায় তিন হাজার টাকা। শুনে বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলাম, কীভাবে বুঝবেন কে গরিব, কে সচ্ছল? হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন বাসার ঠিকানা কোন এলাকায়, সেটা দেখেই বোঝা যাবে, কে সচ্ছল আর কে না।
সারা জীবনই উল্টো ধারার মানুষ ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সবাই বলে চিকিৎসক হওয়ার জন্য অনেক শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা দরকার। জাফরুল্লাহ ভাই মনে করতেন, এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের সাধারণ রোগবালাই দূর করতে চিকিৎসাশাস্ত্রের ডিগ্রির দরকার নেই। অল্প কিছু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দৈনন্দিন বেশির ভাগ রোগবালাইয়ের সুচিকিৎসা সম্ভব।
বাংলাদেশের কয়টি মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতাল ল্যানসেট সাময়িকীটির গ্রাহক, তা জানা নেই। কিন্তু এই ল্যানসেট জার্নালে অল্প প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের ব্যাপারে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল সেই ১৯৭৭ সালে। যখন বাংলাদেশে ওষুধশিল্প ছিল না বললেই চলে, সেই ১৯৮২ সালে তিনি গোঁ ধরেছিলেন যে এ দেশে ওষুধশিল্পের দ্রুত বিকাশ সম্ভব। এই বিকাশের জন্য বিদেশি ওষুধের আমদানি সীমিত করা প্রয়োজন ছিল। দেশে ওষুধনীতি সেই ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করেছিল বলেই আজ আমাদের ওষুধ উৎপাদকদের বিশ্বব্যাপী রমরমা অবস্থা। চিকিৎসাকে জাফরুল্লাহ ভাই ব্যবসা-বাণিজ্যের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। সফল হননি।
চেয়েছিলেন রাজনীতিতে সংলাপ ও সমঝোতা হোক। বিশেষ করে বড় দুই দল বা জোটের মধ্যে। কয়েক দিন আগেই মহামান্য রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে যোগ দিয়েছিলেন অসম্ভবভাবে রোগাক্রান্ত শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে।
যাঁদেরই পেরেছিলেন, তাঁদেরই সংলাপ-সমঝোতার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছিলেন। কেউ তাঁর কথা শোনেনি। আশাবাদী মানুষের আশা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা থাকে অনেক বেশি। এই নিরন্তর আশঙ্কা অনেক সময় মৃত্যুও বোধ হয় ডেকে আনতে পারে।
যে গুটিকয় ব্যক্তি সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে পরের উপকারের চেষ্টা করেন বা করেছেন, তাঁদের মৃত্যু নেই, তাঁরা অমর। যেমন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক