জার্মান সরকারের উচ্চ মহল এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যকার ফাঁস হয়ে যাওয়া টেলিফোন কথোপকথনে বেরিয়ে এসেছে যে ইউক্রেনে এখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লোকজন রয়েছেন।
ফাঁস হওয়া গোপন টেলিফোন কথোপকথনের বরাতে রাশিয়ার গণমাধ্যম আরটির খবরে বলা হচ্ছে, যুদ্ধে সহায়তার জন্য কিয়েভকে যুক্তরাজ্য যে স্ট্রম শ্যাডো ক্রুজ মিসাইল দিয়েছে, সেগুলো পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সেনারা ইউক্রেনে অবস্থান করছেন।
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক নিশ্চিত করেছেন যে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে সহায়তার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অল্প কয়েকজন সদস্য সেখানে রয়েছেন। কিন্তু তিনি বলেন যে বড় আকারের সেনা দল পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা তাঁদের নেই।
অসমর্থিত সূত্রের খবর দাবি করেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর অল্প কয়েক দিন পর থেকেই ব্রিটিশ বিশেষ বাহিনীর লোকজন ইউক্রেনে কাজ করছেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আবারও এ খবর ভিত্তিহীন বলে নিশ্চিত করেছে।
রাশিয়া প্রথম থেকেই বলে আসছে যে ইউক্রেনের মাটিতে যদি অন্য কোনো দেশের কেউ অস্ত্র পরিচালনা কিংবা প্রশিক্ষণে জড়িত থাকেন, তিনি রুশ বাহিনীর হামলার বৈধ লক্ষ্যবস্তু হবেন। এমনকি তৃতীয় কোনো দেশে যদি ইউক্রেনের জন্য অস্ত্র তৈরি করা হয়, সেগুলোও মস্কোর বৈধ লক্ষ্যবস্তু।
ফাঁস হওয়া এই কথোপকথন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। এই যেমন ধরুন, ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া কি যুদ্ধের আওতায় পড়বে? এর মানে কি যুক্তরাজ্য ইউক্রেনের সহযোদ্ধা দেশ বা যুদ্ধ–দোসর?
রাশিয়া ফেডারেশন কাউন্সিলের উপমুখপাত্র কনস্তানিন কোসাচেভ দেশটির রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা তাসকে বলেছেন, ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে ন্যাটোর দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার দিকে এগোচ্ছে।
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে কনস্তানিন কোসাচেভ বলেন, ‘এটিকে তারা ধরে নিতে পারে, ন্যাটো জোট সরাসরি হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এমনকি এটাকে তারা যুদ্ধ ঘোষণা বলেও ধরে নিতে পারে।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পরই কিয়েভের মিত্রদেশগুলো যখন কীভাবে সাড়া দেবে, তা নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু করেছিল, সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিয়েভের কাছে অস্ত্র সরবরাহের আইনগত ভিত্তিটা পুনর্মূল্যায়ন করেছিল।
আন্তর্জাতিক আইন যা–ই বলুক না কেন, তথ্য ফাঁসের এ ঘটনা রাশিয়া-ন্যাটোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। কিন্তু মুখে যতই হুমকি দিক না কেন, রাশিয়া কখনোই ন্যাটোর সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়াতে আগ্রহী নয়। সুতরাং যতই উত্তপ্ত বাক্যযুদ্ধ হোক না কেন, ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে ন্যাটো ও রাশিয়া পরস্পর মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ এ মুহূর্তে খুবই কম।
কয়েক দিনের মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দিয়েছিলেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও তাঁরা সেটাকে ‘যুদ্ধ’ বলে ধরে নেবেন। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সে সময় বলেছিলেন, তৃতীয় কোনো দেশ যদি উড়োজাহাজের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করা হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে ওই দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নিরপেক্ষতার যে আইন প্রচলিত, সেখানে বলা হয়েছে, যদি যুদ্ধরত দেশগুলোর মধ্যে একটি পক্ষ অন্যায্যভাবে আরেকটি পক্ষকে আক্রমণ করে বসে এবং সেই পক্ষ যদি নিজেদের প্রতিরক্ষা করতে অক্ষম হয়, তাহলেই কেউ দেশটিকে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী তৃতীয় কোনো দেশ যুদ্ধে তখনই জড়িয়ে পড়বে, যদি তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি তাদের সেনা নিয়োগ করে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদের গুরুতর লঙ্ঘন। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অন্য কোনো দেশের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড বলে নিন্দা জানিয়েছে।
এ ছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়া নির্বিচার বোমা হামলা ও সহিংসতা এবং বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে হামলা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরমতম লঙ্ঘন করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, রাশিয়াকে এই সংঘাতে কেউ যদি অস্ত্র সরবরাহ করে, সেটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তা দেওয়া এবং ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর কাজে সহযোগিতার সহায়তার মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্য কি ইউক্রেনের সহযোদ্ধা দেশ হয়ে উঠল?
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্ট মীমাংসা নেই। কিন্তু আইনবিশারদেরা মনে করেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরোধে সহায়তা করা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সহযোদ্ধা দেশ হবে না।
কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি যদি যুক্তরাজ্যের সেনারা অভিযান পরিচালনা করেন কিংবা রাশিয়ার বিরুদ্ধে মিসাইল ছোড়েন, তাহলে সেটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য–ইউক্রেন যুদ্ধ–দোসর হবে।
আন্তর্জাতিক আইন যা–ই বলুক না কেন, তথ্য ফাঁসের এ ঘটনা রাশিয়া-ন্যাটোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। কিন্তু মুখে যতই হুমকি দিক না কেন, রাশিয়া কখনোই ন্যাটোর সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়াতে আগ্রহী নয়।
সুতরাং যতই উত্তপ্ত বাক্যযুদ্ধ হোক না কেন, ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে ন্যাটো ও রাশিয়া পরস্পর মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ এ মুহূর্তে খুবই কম।
খ্রিস্টোফ ব্লুথ, ব্র্যাডফোর্ড ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত