১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তার প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। এ কমিটি গঠিত হয়েছিল গত ২৮ আগস্ট। কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও ১১ জন বিশেষজ্ঞকে প্রণয়ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল হিসেবে প্রতিবেদনটি ড. ইউনূসের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেওয়া হয়েছে।
এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩৮২, অধ্যায় সংখ্যা ৫টি (সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক)। এই ৫টি অধ্যায়ের পরিচ্ছেদসংখ্যা (৫ + ৭ + ৬ + ৫) = ২৩। প্রতিবেদনটি যথেষ্ট পরিশ্রম করে অতি অল্প সময়ে প্রণয়নের জন্য ড. দেবপ্রিয় ও তাঁর টিমকে অবশ্যই আমাদের অভিনন্দন জানাতে হবে। এ প্রতিবেদন প্রণয়নের আগে গত তিন মাসে তাঁরা ১৮টি কমিটি মিটিং, ২১টি পলিসি কনসালটেশন ও ৩টি জনশুনানি সম্পন্ন করেছেন বলে জানিয়েছেন।
ড. দেবপ্রিয় আরও জানিয়েছেন, তাঁদের কাজে কেউ কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। এ ছাড়া জনসমক্ষে শিগগিরই ‘উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ নামে আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশের প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। ড. ইউনূস ড. দেবপ্রিয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, রিপোর্টটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা এখান থেকে শিক্ষালাভ করতে পারে।
রিপোর্টের চাঞ্চল্যকর তথ্য
প্রথমেই রিপোর্ট থেকে যে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি সব পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেটি হচ্ছেÑআওয়ামী লীগের ১৬ বছরের রাজত্বকালে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯-২০২৩ সালে পাচারকৃত এই ডলারের পরিমাণ সর্বমোট বৈদেশিক সাহায্য ও নিট বৈদেশিক বিনিয়োগের দ্বিগুণের সমান। তারপরও এসব টাকা থেকে সম্ভাব্য যে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে শিক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্য ব্যয় তিন গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, এডিপি বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও দেরি করার জন্য এডিপির ব্যয় ৭০ শতাংশ নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি হচ্ছে। এ জন্য ক্ষতির পরিমাণ ১৫ বছরে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। অর্থাৎ ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি।
বিশেষভাবে স্টক মার্কেটে দুর্নীতির বিষয়টিও প্রতিবেদনে এসেছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ২০২৪ সালের জুন নাগাদ যে বিপন্ন সম্পদ জমা হয়েছে, তা যদি বিপন্ন না হয়ে ব্যবহারযোগ্য হতো, তাহলে তা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল প্রকল্প অথবা ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া গত দশকে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর জন্য যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি হুন্ডি ব্যবহার করে ভিসা কিনেছে, সেখানে বাইরে চলে গেছে প্রায় ১৩ দশমিক ৪ লাখ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুসারে, এই টাকা দিয়ে উত্তরা-মতিঝিল রুটে চলাচলের জন্য ছয়টি মেট্রোরেল তৈরি সম্ভব হতো।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে অনেক বরাদ্দ অদরিদ্ররা পেয়েছেন বলে জানিয়ে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০২২ সালে এই অবৈধ প্রাপ্তির হার ছিল ৭০ শতাংশ।
দারিদ্র্য হারের হ্রাস নিয়ে যে দাবি বিগত সরকার করত, সে ব্যাপারে বলা হয়েছে, প্রায় দুই কোটি লোক সম্প্রতি একদম দারিদ্র্যের কিনারায় উপনীতি হয়েছেন। এর অর্থ, মাত্র দুই দিন কাজে না গেলেই তাঁরা দারিদ্র্যের কাতারে নেমে আসতে বাধ্য হবেন।
কিছু লোককে বিচারের অধীন নিয়ে এসেছেন এবং সব সরকারি কর্মচারী ও ক্ষমতাবানকে আয় ও সম্পদবিবরণী দাখিলের ব্যবস্থা করেছেন। এগুলো সবই সঠিক দিকে প্রারম্ভিক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন ড. দেবপ্রিয়। কিন্তু শেষ সমাধানটি নির্ভর করবে ড. দেবপ্রিয়র মতে—এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দরকার একটি আপসহীন রাজনৈতিক অঙ্গীকার, যা সমস্যাকে সরাসরি আঘাত করবে।
দুর্নীতির রূপভেদ
বাংলাদেশে আর্থিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অপরাধমূলক ঘুষ-দুর্নীতির বহুরূপী চরিত্র রয়েছে। রূপভেদগুলো রিপোর্টে বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে; যদিও এ ধরনের দুর্নীতির মোট ক্ষতির পরিমাণ টাকায় পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। দুর্নীতির এই প্রকারভেদের তালিকা বিশাল।
এর মধ্যে আছে ব্যাংক দুর্নীতি, অর্থ পাচার দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রকল্প–সম্পর্কিত দুর্নীতি, জমাজমি–স্থাবর সম্পদ অন্যায়ভাবে জোর করে দখল করার দুর্নীতি, জনতহবিলের অর্থ অপখাতে ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি, কর্মচারী ও প্রশাসক নিয়োগে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে দুর্নীতি, ধনীদের অন্যায়ভাবে কর অব্যাহতি, সরকারের ভেতরের খবর বাইরের স্বার্থে গোপনে বাইরের শক্তিকে জানিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি, বাজারের সাপ্লাই চেইনে দুর্নীতি, চাঁদাবাজির দুর্নীতি, একচেটিয়া পুঁজির দুর্নীতি, আইন ও নীতি প্রণয়নে দুর্নীতি ইত্যাদি।
এতসব নানামুখী দুর্নীতির মধ্যে চারটি খাতে ছিল দুর্নীতির মূল চক্র। এগুলো ছিল ব্যাংকিং খাত, ভৌত অবকাঠামো খাত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত এবং আইসিটি খাত। এরপর এর প্রতিষেধকের কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘সর্বব্যাপী দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের এই অসম্পূর্ণ তালিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বেরিয়ে এসে জরুরিভাবে আমাদের সমগ্র ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন, যাতে সর্বত্র শক্তিশালী জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে, সততা ফিরে আসাবে এবং অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তৈরি হবে।’
দুর্নীতির চক্র ভেঙে দিতে হবে
এ রিপোর্টের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এতে বামপন্থীরা যেভাবে অর্থনৈতিক লুটপাটের বিষয়কে ‘অসৎ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী ও অসৎ পুঁজিবাদীদের ত্রিভুজ ক্ষমতাকাঠামো’ থেকে প্রসূত এবং সর্বগ্রাসী স্বজনতোষণমূলক পুঁজিবাদকে দায়ী ও চিহ্নিত করেন, অনেকটা ঠিক সে রকমই কিছু অনুমান, যুক্তিগ্রাহ্য ও তথ্যভিত্তিকভাবে এই সত্যের স্বীকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে ড. দেবপ্রিয় প্রায় এক ভাষাতেই তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
ড. দেবপ্রিয় নিজেই বলেছেন, সমস্যা যতখানি বিস্তৃত ও গভীর ভাবা হয়েছিল, আসলে তা তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ও গভীর। উপসংহারে এসে তাই তাঁর একান্ত উপলব্ধি হচ্ছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ছাড়া এবং বেআইনিভাবে অপরাধকে রেহাই দেওয়া ছাড়া এই বিশাল লুটপাট মোটেও সম্ভব ছিল না। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করে দিয়েছেন।
কিছু লোককে বিচারের অধীন নিয়ে এসেছেন এবং সব সরকারি কর্মচারী ও ক্ষমতাবানকে আয় ও সম্পদবিবরণী দাখিলের ব্যবস্থা করেছেন। এগুলো সবই সঠিক দিকে প্রারম্ভিক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন ড. দেবপ্রিয়। কিন্তু শেষ সমাধানটি নির্ভর করবে ড. দেবপ্রিয়র মতে—এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দরকার একটি আপসহীন রাজনৈতিক অঙ্গীকার, যা সমস্যাকে সরাসরি আঘাত করবে।
এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক