স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কমিশন তাদের সেই দায়িত্ব পালন করে নির্বাচনের তফসিল, মানে তারিখ ঘোষণা করেছে। তবে সরকার বা সরকারি দলের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার বাইরে গিয়ে তারা একটি তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। সহজ করে বললে, সরকার চেয়েছে বলেই নির্বাচন কমিশন এমন একটি বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তফসিল ঘোষণা করেছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলেরই একটি প্রতিফলন ঘটেছে এই তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগ যে একটি নির্বাচনের পথ ধরবে, তা বোঝাই যাচ্ছিল। কোন দল নির্বাচনে এল কি এল না, তা তারা বিবেচনায় নেবে না। বিএনপি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন না আসার ঘোষণা দিয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে। তার মানে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরে নিয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিয়েছে। অনেক কড়া সমালোচক অবশ্য এটাও মনে করেন যে বিএনপি নির্বাচনে না আসুক, সেটাই আসলে আওয়ামী লীগের চাওয়া। তারা বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে কোনো ধরনে ঝুঁকি ছাড়াই একটি নির্বাচন করতে চায়। এটাই তাদের কৌশল।
একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন বা নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের প্রতি আলোচনা বা সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এ ধরনের কোনো প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। তারা শুরু থেকেই এ ব্যাপারে একটি কঠোর ও অনমনীয় অবস্থান নেওয়ার নীতি নিয়েছে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা।
বুধবার সন্ধ্যায় যে তফসিল ঘোষণা করা হলো, সে অনুযায়ী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি কেমন হতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে তফসিল ঘোষণার আগে-পরের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলার মধ্যেই তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে দলটির প্রধান কার্যালয় এখনো তালাবদ্ধ। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই এখন কারাগারে। বাকিরা পালিয়ে অথবা আত্মগোপনে রয়েছেন।
গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজার হাজার কর্মী। দেশজুড়ে তাঁদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে। সেই সঙ্গে ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটছে। ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৯ জনের।
একতরফা নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের রয়েছে। ফলে তাদের এই আত্মবিশ্বাস থাকা স্বাভাবিক যে এবারও তারা সে ধরনের নির্বাচন করে সফল হবে এবং আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবে। কিন্তু এরপরও এই প্রশ্ন তুলতেই হচ্ছে যে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত কৌশল হিসেবে কেমন হলো?
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করার পর আওয়ামী লীগের লোকজন আনন্দ উল্লাস করেছেন। বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে রাজপথ এখন মূলত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে।
তফসিল ঘোষণা করার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সংঘাত পরিহার করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।’ কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বেশ স্পষ্টভাবেই সংলাপের বিষয়টি বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংলাপের সময় শেষ হয়ে গেছে।
আর যে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচন অনুষ্ঠানের, সেই কমিশন ভবনের নিরাপত্তায় নিশ্চিত করতে হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া তফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচন কমিশন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিয়েছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তাদের শান্তিনগর মোড়ের বেশি এগোতে দেওয়া হয়নি।
এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা আগামী নির্বাচনটি কেমন হতে পারে, তার একটি ধারণা করতে পারি। আওয়ামী লীগ যেহেতু সংলাপের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে এবং বিএনপি যদি স্বেচ্ছায় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে ৭ জানুয়ারি আবারও দেশে একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে না গেলে বিএনপি যে এই নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ধরনের ক্ষেত্রে অতীতে তারা সফল হয়নি, ফলে বিএনপির নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা আন্দাজ করা কঠিন। তবে সংঘাত–সহিংসতা যে হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
একতরফা নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের রয়েছে। ফলে তাদের এই আত্মবিশ্বাস থাকা স্বাভাবিক যে এবারও তারা সে ধরনের নির্বাচন করে সফল হবে এবং আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবে। কিন্তু এরপরও এই প্রশ্ন তুলতেই হচ্ছে যে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত কৌশল হিসেবে কেমন হলো?
নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে বিরোধ মীমাংসার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত চলে যাওয়া—আওয়ামী লীগের এই যে কৌশল, তা পুরোপুরি একমুখী। ফিরে আসার কোনো পথ তারা রাখতে চায়নি। তফসিল ঘোষণার সময় সিইসি সংলাপের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা নাকচ করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তা বুঝিয়েও দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে যেভাবেই হোক একটি নির্বাচন দলটিকে করতেই হবে। এর ফলে আবারও যে একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দায় দলটিকে নিতে হবে, তা তাদের অজানা নয়। নতুন করে যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করতে হবে, সেটাও নিশ্চয়ই তাদের বিবেচনায় রয়েছে। তবে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় এবার এই আন্তর্জাতিক চাপ ভিন্ন মাত্রা পেতে পারে।
আওয়ামী লীগ যে কৌশলের ওপর ভর করে এ পর্যন্ত এসেছে, তাতে পেছনে ফেরার তেমন সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে যেকোনো মূল্যে তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনের পথেই সম্ভবত তারা এগোবে। নির্বাচন নিয়ে এখনো যাঁরা সমঝোতার আশা করছেন, তাঁদের হতাশ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সংঘাত-সহিংসতা ছাড়া তো সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এর পরে কী?
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক