প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চেষ্টা করেও ‘কংগ্রেসমুক্ত’ ভারত গড়তে পারলেন না। কিন্তু অনায়াসে দক্ষিণ ভারতকে ‘বিজেপিমুক্ত’ করে দিলেন! কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের নির্যাস সংক্ষেপে এভাবেও বর্ণনা করা যায়।
কর্ণাটকের বিপর্যয়ের জন্য নরেন্দ্র মোদিই দায়ী। ভরাডুবির পূর্ণ দায় তাঁর ও তাঁরই ছায়া অমিত শাহর। রণনীতি তাঁরাই ছকেছেন। রাজ্য নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে নীতি রূপায়ণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বি এল সন্তোষ ও প্রহ্লাদ যোশীকে। আগাগোড়া উপেক্ষা করেছেন কর্ণাটকে বিজেপির জন্মদাতা ও পালক বি এস ইয়েদুরাপ্পাকে। এর কুফলও পেয়েছেন হাতেনাতে, মুখ ফিরিয়েছে লিঙ্গায়েত গোষ্ঠী।
মোদি-শাহ ভেবেছিলেন, আর্যাবর্তের ছক বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণেও সফল হবে। ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা এবং নিজেদের প্রশ্নের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দলকে ইন্দিরা আমলের কংগ্রেসতুল্য তাঁরাই করে তুলেছেন। এখন সেই ভুলের মাশুল গুনছেন।
ভুল অবশ্য গাদা গাদা। মানুষের ক্ষোভ নিরসনের কোনো চেষ্টা মোদি-শাহ করেননি। ক্ষোভ চাপা দিতে কংগ্রেসকে পাল্টা আক্রমণ শাণিয়ে বরং বিপদ বাড়িয়েছেন। সরকারের ৪০ শতাংশ অপদার্থতা আড়াল করতে ৪০ বছর আগের কংগ্রেসের দুর্নীতি টেনে নিজেদের দুর্নীতিকেই সমর্থন করেছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ধর্মীয় মেরুকরণের। কর্ণাটকবাসী এই ছক বানচালই শুধু করেনি, এর ফলে মুসলমান সমর্থন পুরোপুরি কংগ্রেসে ঢলে পড়েছে। দক্ষিণ কর্ণাটকের মুসলমানরা এত বছর জেডিএস ও কংগ্রেসকে সমান সমর্থন করেছেন। এবার তাঁরা একমাত্র কংগ্রেসকেই বেছে নিয়েছেন। ওই তল্লাটের ৬৪ আসনের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছে ৪৪টি।
বিধানসভার ভোটকে জাতীয় চরিত্রে মুড়ে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও দুর্নীতির নাগপাশমুক্ত হতে চেয়েছিলেন মোদি। প্রচারে এসব নিয়ে তিনি যত মৌন, কংগ্রেস তত মুখর। ইশতেহারে জনমুখী পাঁচ প্রতিশ্রুতির উল্লেখই শুধু নয়, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের ‘ষষ্ঠ প্রতিশ্রুতি’—মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই পাঁচ অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হবে। মোদি কর্ণাটকের ‘গ্লোবাল ইমেজ’ বাড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন, কংগ্রেস ফেরি করেছে দারিদ্র্য মোচনের ছোট ছোট স্বপ্ন।
শেষবিচারে লড়াইটা তাই হয়ে ওঠে মোদি বনাম কংগ্রেস, দারিদ্র্য বনাম বৈভবের। কংগ্রেস দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের সহায়। মোদি বিত্তবানের প্রতিভূ। দলিত, তফসিলি জাতি-উপজাতি, অনগ্রসর এবং মুসলমান কংগ্রেসকে কীভাবে আঁকড়ে ধরেছে, তার ছোট্ট নমুনা—১৩৫টি আসনের অর্ধেকের জয় ৫০ শতাংশের বেশি ভোটে! জোয়ার নয়, কংগ্রেসকে কর্ণাটক বানভাসি করেছে।
১০ বছর ধরে এ লক্ষ্যে আগুয়ান মোদি-শাহর বিজেপি ২০২৪ সালেও সফল হবে কি না, কর্ণাটকবৃত্তান্ত সেই প্রশ্ন নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। এই পথ পরিত্যাগের ইচ্ছা বা উপায়ের কোনো রকম ইঙ্গিত মোদি এখনো দেননি। একদর্শী এই ভারতের বিপ্রতীপে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াতে কর্ণাটকের ফল প্রেরণাদায়ক হবে কি? কেন্দ্রে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনে ওডিশার নবীন পট্টনায়ক নেই। দিল্লিতে মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর নবীন নিজেই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশের দুই শাসক চন্দ্রশেখর রাও ও জগনমোহন রেড্ডিকে কংগ্রেস আমল দেবে না। একই রকম অনুৎসাহ মায়াবতীকে নিয়েও।
বিজেপি কর্ণাটক থেকে শিক্ষা নেবে কি না জানি না। মোক্ষম শিক্ষা, ধর্মীয় মেরুকরণের চরিত্র সর্বভারতীয় নয়। উত্তর ভারতে যা চলে, দক্ষিণে তা অচল। সবার জুতার মাপ এক নয়। দরিদ্র, বিহ্বল ও বিচলিত মানুষের কাছে ধর্মের রাজনীতি দুঃখ-দুর্দশার প্রলেপ হতে পারে না। অভাব, যাতনা, কর্মচ্যুতি, হাহাকারক্লিষ্ট মানুষের দুর্দশা না ঘুচিয়ে দেড় বছর ধরে বিজেপি শুধুই হিজাব-হালাল-আজান-টিপু-সাভারকর করে গিয়েছে। এই রাজনীতি উপকূলবর্তী এলাকা ছাড়া কোথাও কলকে পায়নি। ক্ষুধার বিকল্প ধর্ম নয়। বিজেপি শিক্ষিত হবে কি?
জয়ে গা ভাসানোর অবকাশ অবশ্য কংগ্রেসের নেই। এই জয় আগামী দিনের বাধাগুলো সরিয়ে দেবে, তেমন ভাবারও কারণ নেই। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার প্রয়োজন তাদের ছিল। কর্ণাটকই ছিল তার উপযুক্ত রণক্ষেত্র। কিন্তু বর্ষশেষে তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের বৈতরণি যে হেলায় পেরোবে, তার মানে নেই। তেলেঙ্গানায় কংগ্রেস কর্ণাটকের মতো সবল নয়। রাজস্থানে আবার সরকার গড়তে হলে অশোক গেহলট ও শচীন পাইলটকে সিদ্দারামাইয়া ও শিবকুমারের মতো আচরণ করতে হবে। বৃত্তকে চতুষ্কোণে পরিণত করার মতোই তা কঠিন। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি টলমলে। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বেরিয়ে যাওয়ার পর সেখানে কংগ্রেসের দলীয় কোন্দলও কম।
কিন্তু শিবরাজ সিং চৌহান কঠিন ঠাঁই। ছত্তিশগড় ধরে রাখা সহজতর। বছর শেষের এই চ্যালেঞ্জ জিততে কংগ্রেসকে বাড়তি উদ্যোগী হতে হবে। কর্ণাটক অবশ্যই কংগ্রেসের মনোবল বাড়িয়েছে। ‘আমরাও পারি’—এ বিশ্বাস ফিরিয়েছে। বুঝিয়েছে, মোদি অজেয় নন। কিন্তু সেটাই সব নয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর অনেক কিছু নির্ভরশীল। প্রথম পরীক্ষা—নির্ঝঞ্ঝাটে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাছা।
কর্ণাটকের ফল প্রকাশ পর্যন্ত কংগ্রেস ছিল চমৎকার ঠাসবুনন। একবারের জন্যও মনে হয়নি মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে দলটা আড়াআড়ি বিভক্ত। সিদ্দারামাইয়া ও শিবকুমার—দুজনই মুখ্যমন্ত্রিত্বের জোরালো দাবিদার। দুজনকে খুশি করার কাজ মল্লিকার্জুন ও গান্ধীরা কীভাবে করবেন, তা অজানা। এই অসাধ্যসাধন অন্য রাজ্যের যুযুধান শিবিরের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারে। নেতাদের বোঝা উচিত, গোড়া কেটে আগায় জল ঢালা অর্থহীন। দল টিকলে তাঁরাও টিকবেন। এই বোধোদয়ের ওপর অনেকটাই ঝুলে থাকবে চার রাজ্যের কংগ্রেসের ভাগ্য।
রাজনীতিতে যেকোনো ঘটনাই অনুরণন সৃষ্টি করে—সাময়িক অথবা দীর্ঘমেয়াদি। কর্ণাটকের মতো বড় রাজ্যের পালাবদলের অভিঘাতও তাই উপেক্ষণীয় নয়। আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। ভুল থেকে শিক্ষা না নিলে বিজেপির বিপদ। ক্ষমতার অতিকেন্দ্রিকতা থেকে সরে এসে বিকেন্দ্রীকরণে জোর না দিলে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ দুশ্চিন্তা বাড়াতে পারে। কর্ণাটকে কংগ্রেসি মডেল কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই সম্মান জানিয়েছে। অথচ বিজেপি এগোচ্ছে ‘এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক দল, এক আদর্শ ও এক নেতা’ প্রতিষ্ঠার তাড়নায়।
১০ বছর ধরে এ লক্ষ্যে আগুয়ান মোদি-শাহর বিজেপি ২০২৪ সালেও সফল হবে কি না, কর্ণাটকবৃত্তান্ত সেই প্রশ্ন নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। এই পথ পরিত্যাগের ইচ্ছা বা উপায়ের কোনো রকম ইঙ্গিত মোদি এখনো দেননি। একদর্শী এই ভারতের বিপ্রতীপে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াতে কর্ণাটকের ফল প্রেরণাদায়ক হবে কি? কেন্দ্রে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনে ওডিশার নবীন পট্টনায়ক নেই। দিল্লিতে মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর নবীন নিজেই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশের দুই শাসক চন্দ্রশেখর রাও ও জগনমোহন রেড্ডিকে কংগ্রেস আমল দেবে না। একই রকম অনুৎসাহ মায়াবতীকে নিয়েও।
তাঁদের বাইরে থাকছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কংগ্রেসের প্রতি এই তিন নেতা ইদানীং কিছুটা নরম, কিন্তু এখনো পুরোপুরি রাহুল-অস্বস্তিমুক্ত নন। কর্ণাটক জয়ের পর অত্যুৎসাহীরা রাহুলের নেতৃত্বের প্রশ্নে গোঁ ধরলে পণ্ডশ্রম হতে পারে। সেই প্রবণতা দেখাও গেছে। এটা কাজের কথা নয়; বরং অনেক বেশি কাজে আসবে পূর্ব-পশ্চিমের ভারত জোড়ো যাত্রা।
রাজ্য স্তরে যা-ই হোক, কেন্দ্রীয় স্তরে মোদি এখনো অবিকল্প। সেটাই তাঁর শক্তি। ২০১৮ সালে কর্ণাটকে কংগ্রেস ৮০ আসন জিতলেও পরের বছর লোকসভা ভোটে ২৮-এর মধ্যে পেয়েছিল একটিমাত্র আসন। গুজরাটেও কংগ্রেস জিতেছিল ৭৮টি আসন, লোকসভায় একটিও নয়!
একই দৃশ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লি ও ওডিশাতেও। এটাই এখন ট্রেন্ড। রাজ্যে যে কেউ, কেন্দ্র মোদি। দৃঢ় ও নির্ণায়ক প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেশ নিরাপদ যাঁরা মনে করেন, তাঁদের মন ঘোরাতে গেলে লোকসভা ভোটকে আঞ্চলিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখতে হয়। তা সম্ভব বিশ্বাসের আধারে বিরোধী জোট জমাট হলে। এই পরীক্ষায় কংগ্রেস ব্যর্থ হলে মোদির হ্যাটট্রিক অবশ্যম্ভাবী।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি