বাসার ঢাউস সাইজের রেডিওটা হঠাৎ একদিন বিগড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছিলেন আব্বা। কারণ, তাঁর প্রতিদিনকার রুটিন ছিল সন্ধ্যায় মেজ চাচা এলে দুজনে বসে বিবিসি শোনা। প্রবাহ দিয়ে শুরু এবং পরিক্রমা দিয়ে শেষ। সকালে নিয়মিত প্রভাতি অনুষ্ঠান চলতেই থাকবে—এ ছিল নিত্যদিনের রুটিন। সেদিন সেই ভাঙা রেডিওটি কোনোমতে মেরামত করে খবর শোনা হয়েছিল।
পরদিনই একটা নতুন রেডিও নিয়ে আব্বা বাসায় এলেন। কারণ, তখন সময়টা ছিল ১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সামরিক শাসনামলের পুরো সময়টা বিবিসি ছাড়া খবর পাওয়ার আর কোনো উপায় ছিল না। সেই সময় ইন্টারনেট, মুঠোফোন, বিভিন্ন চ্যানেল, ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া, গুগল—কিছুই ছিল না। আমাদের কত স্মৃতি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) এ বাংলা বিভাগের সঙ্গে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তো বিবিসিই ছিল বড় ভরসা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অবরুদ্ধ ঢাকায় বিবিসি ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের খবর পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আর বিবিসি—এই দুই–ই ছিল বাঙালির শক্তি।
ভয়েস অব আমেরিকা (ভোয়া) চালু থাকলেও সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা কম ছিল। বিবিসি থেকে বাংলা সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৪১ সালে। সে সময় বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় দেড় কোটি বাংলাভাষী মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ পরিবেশনা ও সংবাদের ভিন্নধর্মী স্টাইলের কারণে জনপ্রিয় নাম হচ্ছে বিবিসি। বয়স কম হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক স্মৃতি স্পষ্ট মনে করতে পারি। বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলা অবরুদ্ধ ঢাকায় বসবাসকারী দু–একজন আত্মীয় আমাদের বাসায় আসতেন এবং বসার ঘরে খুব কম আওয়াজে বিবিসি শুনতেন। এমনকি যখন ব্ল্যাকআউট চলত, তখনো রেডিও ও ছোট একটি হারিকেন নিয়ে আমরা খাটের নিচে আশ্রয় নিতাম। আর যা–ই হোক, আব্বার পক্ষে বিবিসির সন্ধ্যাকালীন বা রাতের খবর মিস করা চলবে না।
করপোরেশনটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সমন্বিত চাপের ফলে ‘কঠিন এ সিদ্ধান্তের দিকে যেতে হচ্ছে’। হয়তো সবকিছুর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী এ সংবাদমাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে চিরকালের জন্য জড়িয়ে থাকবে বিবিসি বাংলার নাম।
সেই বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হতে যাচ্ছে। সকালে উঠেই মনটা খারাপ হয়ে গেল, প্রথম আলো অনলাইনে এ খবর দেখে। বিবিসি বাংলা শুনত আমার দাদা, বাবা ও আমাদের প্রজন্ম। এখনো অনেকেই বিবিসি শোনেন নিয়মিত। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে ভয়াবহ অত্যাচার–নিপীড়ন চালাচ্ছে, বিবিসির মাধ্যমেই তা বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল। নয়তো পশ্চিম পাকিস্তানিরা একে নিছক গৃহযুদ্ধ হিসেবেই প্রচার করছিল। শুধু বিশ্ববাসীই নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষও এই বিবিসি বাংলা রেডিও শুনেই মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর পেতেন। বলা যায়, সেই সময়ে পুরো দেশের মানুষের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাত এ বিবিসি।
স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে বসে দাদা, চাচারা বিবিসি শুনতেন সেই পুরোনো বড় কাঠের বাক্সের মতো ৮/১০ ব্যান্ডের রেডিওতে এবং সবাই একসঙ্গে বসে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েক গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে এক রেডিওতে খবর শুনতেন বলে পাকশীর একটি বাজারের নামকরণ হয়ে যায় বিবিসি বাজার। সেই সময় সব বাড়িতে রেডিও ছিল না। কুড়িগ্রামে বিবিসির মোড় নামে একটা জায়গা আছে, আছে ঈশ্বরদীতেও। একাত্তরে ‘ওডিসি’ নাটকটা অনেকে শুনতেন এ বিবিসি মোড়ে বসেই।
সেই বিবিসি বাংলা বন্ধের খবরটি শ্রোতাদের জন্য খুব কষ্টের বৈকি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার পর জাতি যখন সম্পূর্ণ অন্ধকারে, তখন থেকে পুরো সামরিক শাসনামলেই প্রতিদিন বাসায় সকাল, সন্ধ্যা ও রাতে বিবিসি শোনা হতো। কারণ, তখন সব তথ্য গিলে ফেলা হতো। দেশের মিডিয়াতে কোনো খবর ছিল না। সামরিক জান্তা কোনো সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করতে দিত না। সেই সময়ও আমাদের সংবাদের অন্যতম উৎস ছিল একমাত্র বিবিসি।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে এই বিবিসিই ছিল ভরসা। এরশাদ আমলে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম, তখন আমাদের ক্লাস নিতে এলেন বিবিসির সাংবাদিক আতাউস সামাদ স্যার। বিবিসিতে কত নিউজ শুনেছি আতাউস সামাদের, আর আজ চোখের সামনে দেখতে পারছি, ক্লাস করছি সেই মানুষের। স্যার রিপোর্টিং ক্লাস নিতে গিয়ে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের অনেক গল্প শোনাতেন এবং সেগুলোর মাধ্যমেই শেখানোর চেষ্টা করতেন।
সেই বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হতে যাচ্ছে। বাংলার পাশাপাশি আরবি, হিন্দি, ফারসি, চীনাসহ মোট ১০টি ভাষার রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করে দিচ্ছে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস। তবে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, রেডিও কেউ শোনেন না। শুধু শুধু অ্যান্টিক হিসেবে এটা চালু রাখার বিলাসিতা ব্রিটিশরা কেন করবে। আর বিবিসি বাংলার অনলাইন ভালোই চলছে।
করপোরেশনটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সমন্বিত চাপের ফলে ‘কঠিন এ সিদ্ধান্তের দিকে যেতে হচ্ছে’। হয়তো সবকিছুর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী এ সংবাদমাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে চিরকালের জন্য জড়িয়ে থাকবে বিবিসি বাংলার নাম।
শাহানা হুদা উন্নয়নকর্মী