ঢাকা থেকে যত দূরে যাই, ততই মনে প্রশান্তি জাগে। ঢাকা থেকে বাইরে যাওয়া মানে নিত্য যানজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকা। রাজনীতির কোলাহল থেকে দূরে থাকা। জন্মদিনে কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন:
‘কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।’
আলোঝলমল রাজধানীতে বসে মাটির কাছাকাছি মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। সে জন্য কৃষকের জীবনের শরিকদের কাছেই যেতে হয়।
প্রথম আলোর সুধী সমাবেশে যোগ দিতে ৬ ও ৭ জানুয়ারি যথাক্রমে কুমিল্লা ও ফেনীতে গিয়েছিলাম। সহযাত্রী ছিলেন প্রথম আলোর ইভেন্টের আশফাক হোসেন। নামে সুধী সমাবেশ হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল প্রথম আলোর পাঠকদের সম্মিলন। সুধী সমাবেশে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ পদাধিকারী ব্যক্তি, ছিলেন লেখক-গবেষক, আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, সরকারি- বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী। ছিলেন তরুণ উদ্যোক্তা, মেধাবী শিক্ষার্থী ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও।
কুমিল্লার সুধী সমাবেশটি আয়োজন করা হয়েছিল নবাব ফয়জুননেসা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মিলনায়তনে। আর ফেনীর সমাবেশ হয় ভাষাশহীদ আবদুস সালাম কমিউনিটি সেন্টারে। দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় জড়িত। নবাব ফয়জুননেসা ছিলেন এ অঞ্চলে নারী জাগরণের অগ্রদূত। আর যাঁদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি, তাঁদেরই একজন আবদুস সালাম।
কথায় বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। যেহেতু রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি, সুধী সমাবেশের সুযোগে ফেনী ও কুমিল্লার রাজনীতির হালচাল আঁচ করার চেষ্টা করলাম। হবু বিভাগীয় শহর কুমিল্লা ও জেলা শহর ফেনীর মধ্যে একটা আশ্চর্য মিল খুঁজে পেলাম। দুই শহরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের ‘দুই নেতা’; যাঁরা স্থানীয় সংসদ সদস্যও। সেখানে তঁাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
দুই সমাবেশেই পাঠকেরা প্রথম আলোর কাছে তাঁদের প্রত্যাশা ও দাবির কথা তুলে ধরেছেন। গত ২৪ বছরে সত্যে-তথ্যে প্রথম আলো দেশে-বিদেশে কেবল লাখ লাখ পাঠকের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেয়নি, পরিণত হয়েছে তাঁদের আস্থার প্রতীকে। যেমন ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল-হাসান বললেন, প্রথম আলো সব সময় সংবাদ, ভাষা, সাহিত্য, বানান, শব্দ গঠনসহ সব ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়। কিংবা যদি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের কথাটি স্মরণ করি, ‘দেশে-বিদেশে যেখানেই ছিলাম, প্রথম আলোতে আস্থা রেখেছি।’
প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকা প্রতিদিন পড়েন ৫০ লাখ পাঠক। আর সারা বিশ্বে এক নম্বর বাংলা পোর্টাল এটি। এই আস্থা একদিকে প্রথম আলোকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়, অন্যদিকে এর কর্মীদের সুসাংবাদিকতার দায়িত্বশীলতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আবারও রবীন্দ্রনাথকে ধার করে বলতে হয়, ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।’
অনেক পাঠক বলেছেন, তঁারা পত্রিকা, টিভি, অনলাইন পোর্টাল, ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদি মাধ্যমে প্রতিদিন অনেক তথ্য পান; কিন্তু প্রথম আলোতে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তা বিশ্বাস করেন না। দুটি সুধী সমাবেশে অংশ নেওয়া পাঠকেরা প্রথম আলোর কাছে আরও বেশি স্থানীয় খবর প্রকাশ করার দাবি জানালেন। কেবল রাজনীতি কিংবা অপরাধের খবর নয়; আরও বেশি করে ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বিনোদনের খবর চান তঁারা। আরও বেশি সাফল্যের কাহিনি পড়তে চান। তাঁদের বিশ্বাস, প্রথম আলোতে কোনো সমস্যার খবর এলে প্রশাসন সক্রিয় হয়। প্রতিকার পাওয়া যায়। অতীতের মতো প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের পক্ষে, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখবে, কারও চোখ রাঙানির কাছে পরাভব মানবে না, এই অঙ্গীকারও শুনতে চাইলেন পাঠকেরা। আবার কেউ কেউ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথাও বললেন।
অনেকের ধারণা, তরুণেরা পত্রিকা পড়েন না। সারাক্ষণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু কুমিল্লা ও ফেনীর সমাবেশে অনেক তরুণের উপস্থিতি আমাদের আশান্বিত করে। জানতে চাইলাম, ‘আপনারা ছাপা পত্রিকা পড়েন, না কেবল অনলাইনে প্রথম আলো দেখেন?’ বেশির ভাগ হাত তুলে জানালেন, তাঁরা ছাপা পত্রিকা ও অনলাইন দুটোই পড়েন।
আমরা আরও আশ্বস্ত হলাম, যখন একাধিক তরুণ পাঠক বললেন, পাঠাগার আন্দোলনসহ স্থানীয় সব ভালো কাজে তাঁরা প্রথম আলোকে সঙ্গে পেতে চান। এই তরুণেরা মনে করেন, স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সক্রিয় হলে কিংবা পাঠাগার আন্দোলনে তরুণদের যুক্ত করতে পারলে মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য দূর হবে। তঁারা প্রথম আলোর স্লোগানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে তঁারাও একাত্ম হতে চান। বিবদমান রাজনীতি নিয়ে তঁারা মাথা ঘামান না। কিন্তু প্রথম আলোতে ভরসা রাখেন।’
কুমিল্লার আয়োজনে সহকর্মী গাজীউল হক এবং এম এ সাদেক সবকিছু সামাল দিয়েছেন। ফেনীতে প্রথম আলোর হেড অব রিপোর্টিং টিপু সুলতান যুক্ত হওয়ায় প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি আবু তাহেরের পক্ষে আয়োজনটি করা সহজ হয়েছে। দুই স্থানেই শীত উপেক্ষা করে প্রথম আলোর বন্ধুসভার বন্ধুরা যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, সে কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে।
কথায় বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। যেহেতু রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি, সুধী সমাবেশের সুযোগে ফেনী ও কুমিল্লার রাজনীতির হালচাল আঁচ করার চেষ্টা করলাম। হবু বিভাগীয় শহর কুমিল্লা ও জেলা শহর ফেনীর মধ্যে একটা আশ্চর্য মিল খুঁজে পেলাম। দুই শহরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের ‘দুই নেতা’; যাঁরা স্থানীয় সংসদ সদস্যও। সেখানে তঁাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তাঁরা যে দলেরই হন না কেন, দুই নেতার ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারেন না। দুই স্থানে কয়েক মাস আগে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলেও অজ্ঞাত কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি।
কুমিল্লায় বিএনপির লেজেগোবরে অবস্থা। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ও নিজামুউদ্দিন কায়সার দল থেকে বহিষ্কৃত; যদিও তাঁরা দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। ফেনীর তিন আসনে তিন দলের তিনজন প্রতিনিধিত্ব করছেন—আওয়ামী লীগের নিজামউদ্দিন হাজারী, জাসদের শিরীন আখতার ও জাতীয় পার্টির মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল না থাকলে গেল সিটি নির্বিাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হতে পারতেন না। অন্যদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইকবাল সোবহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে জয়নাল হাজারী প্রকাশ্য অবস্থান না নিলে বিএনপির জয়নাল আবদিন, যিনি ভিপি জয়নাল নামে অধিক পরিচিত, জিততে পারতেন না। একেই বলে শত্রুর শত্রু পরম মিত্র।
স্থানীয় রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ফেনীর এক সাংবাদিক বন্ধু জানালেন, বিএনপি আমলে এখানে আওয়ামী লীগের ‘বড় নেতা’ দেশান্তরী হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির নেতারা মাঝেমধ্যে এসে রুটিন কর্মসূচি পালন করে চলে যান।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি