একটা দেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দুই শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাঁরা হলেন—শিক্ষক ও চিকিৎসক। পরপর দুই দিনে এই শ্রেণির মানুষদের প্রকাশ্য পিটিয়ে আহত করেছে পুলিশ। তাঁদের অপরাধ কী ছিল? ন্যায্য অধিকার আদায়ে দাবি তুলেছেন, এটাই তাঁদের অপরাধ।
আমার বাবা একজন শিক্ষক হওয়ার কারণে খুব কাছে থেকে দেখেছি, তিনি কতটা যত্নবান ছিলেন ছাত্রছাত্রীদের প্রতি। এটাও দেখেছি, তাঁর স্বল্প টাকায় কী নিদারুণ কষ্ট করে আমাদের ভাই-বোনদের পড়াশোনা করিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁর গরিব ছাত্রদেরও পড়িয়েছেন। বিনিময় পেয়েছেন ভালোবাসা ও সম্মান। অথচ বর্তমান প্রজন্মের কেউ শিক্ষক হতে চান না। একাধিক চাকরি খোঁজার পর উপায়ান্তর না পেয়ে শিক্ষক হতে আসেন।
কেন তরুণেরা আজ শিক্ষকতার প্রতি বিমুখ, তার উত্তর তো পাচ্ছেন গত কয়েক দিনে দেশের ঘটনাপ্রবাহ থেকে। এ পেশায় চলে চরম বৈষম্য। বিশেষ করে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধায় করা হয় পাহাড়সম বৈষম্য।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া, ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। অথচ একই কারিকুলামের অধীন একই সিলেবাস, একই একাডেমিক সময়সূচি, একইভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজে নিয়োজিত থেকেও বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি আর্থিক সুবিধায় করা হয় চরম বৈষম্য। বেসরকারি শিক্ষকেরা ঠিকমতো পান না কোনো বিশেষ ভাতা।
যদি ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী একজন তরুণকে এখন জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন কী? তিনি অনায়াসে উত্তর দেবেন, এই দেশ ছেড়ে যাওয়াই এখন তাঁর বড় স্বপ্ন। কেন তরুণেরা আজ দেশ ছেড়ে চলে যেত উঠেপড়ে লেগেছেন, এই প্রশ্নের উত্তর কি রাষ্ট্র কখনো খুঁজতে চেয়েছে? চায়নি। যদি চাইতো, তাহলে আজ এভাবে শিক্ষক-চিকিৎসকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামতে হতো না।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বেতন স্কেল এক ধাপ নিচে এবং সহকারী প্রধান শিক্ষকদের উচ্চ স্কেল প্রদান না করায় উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষকদের বেতন স্কেল ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল সমান হয়ে আছে। এই বৈষম্যের মধ্য দিয়ে একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চলতে পারে?
শিক্ষকেরা তাঁদের অধিকার আদায়ে দাবি তুলতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন প্রেসক্লাবের সামনে। এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ তাঁদের পিটিয়ে আহত করেছে। মানুষ গড়ার কারিগরদের গায়ে হাত তোলার ক্ষমতা পুলিশকে কে দিল?
পৃথিবীর প্রতিটি দেশে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা হয়। তাঁদের দেওয়া হয় সর্বোচ্চ বেতন-ভাতা। আর বাংলাদেশে অন্য সব পেশায় যখন পারিশ্রমিক ঊর্ধ্বগতির দিকে, সেখানে জাতির আসল সৈনিক, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের পারিশ্রমিক নিম্নগামী। তাঁদের ন্যায্য পারিশ্রমিক আদায়ের দাবি তুললে কপালে জোটে পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল, গরম পানি, পেপার স্প্রে—এমনকি কোনো কোনো সময় গুলিও চলে তাঁদের বুকে। পৃথিবীর আর কোনো সভ্য দেশে এমনটি দেখতে পাবেন না!
পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেলে প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকেরা তাঁদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন, সেখানেও পুলিশ তাঁদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। তাঁদের মাসিক বেতন-ভাতা দেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। আজকের এই সময়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে কেউ সংসার এবং নিজের খরচ চালাতে পারবে?
প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছর এবং তাঁরা বেশির ভাগই বিবাহিত। ২০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে তাঁরা পরিবার চালাতে পারবেন? শহরে ন্যূনতম দুই থেকে তিন সদস্যের একটা পরিবারেও মাসে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা প্রয়োজন।
তা-ও হিমশিম খেতে হয়। সেখানে নন-রেসিডেন্ট চিকিৎসকেরা ২০ হাজার টাকায় কীভাবে মেটাবেন তাঁদের খরচ। তাঁদের কোনো সুযোগও থাকে না কোর্সে থাকাকালীন অন্য কোনো চাকরি, ডিউটি, চেম্বার করার। একজন চিকিৎসককে দেখলাম ক্যামেরার সামনে বলছেন, তাঁর একটি সন্তান আছে। এখনো তিনি নিয়মিত তাঁর বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেন খরচ চালাতে। ব্যাপারটা তাঁর জন্য কতটা হৃদয়বিদারক! বিবাহিত জীবনে এসেও তাঁকে বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিতে হয় পরিবারের খরচ চালাতে।
যদি ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী একজন তরুণকে এখন জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন কী? তিনি অনায়াসে উত্তর দেবেন, এই দেশ ছেড়ে যাওয়াই এখন তাঁর বড় স্বপ্ন।
কেন তরুণেরা আজ দেশ ছেড়ে চলে যেত উঠেপড়ে লেগেছেন, এই প্রশ্নের উত্তর কি রাষ্ট্র কখনো খুঁজতে চেয়েছে? চায়নি। যদি চাইতো, তাহলে আজ এভাবে শিক্ষক-চিকিৎসকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামতে হতো না।
ফরিদ উদ্দিন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক