মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী? এ বছর কুয়ালালামপুরে এশিয়া-প্যাসিফিক গোলটেবিল উদ্বোধনী অধিবেশনের মূল প্রশ্ন ছিল এটি। আমার জবাব ছিল, না। এই যুদ্ধ এড়ানো যায়। কিন্তু কয়েক বছর আগে এমন কিছু কল্পনা করা যেত না, প্রায় অসম্ভব ভাবনা বলেই মনে হতো। এখন একটা ভুল পথে এগোচ্ছি আমরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার ব্যাপারে দুই পক্ষই এখন ঐকমত্যে পৌঁছেছে। চীনের উসকানিমূলক আচরণের মুখে নির্বাচনের এই সময়টায় বাইডেনের পক্ষে নরম হওয়ার সুযোগও নেই।
তাইওয়ান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক আচরণ দুর্ঘটনার (উদ্দেশ্যমূলক) কারণ হতে পারে, যা এমনকি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং এই নির্বাচনকে চীন কীভাবে নিচ্ছে তা অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে।
তাইওয়ানকে জবরদখল করার মতো সক্ষমতা পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) অর্জন করে ফেলেছে বলে তারা বিশ্বাস করে। সি চিন পিং এ ব্যাপারে একমত। আর এ থেকেই তাইওয়ানের বিরুদ্ধে পিআরসির অভিযান যাওয়ার যে আশঙ্কা তা বাড়তে থাকে। তাই এ অঞ্চলে খুব দ্রুত উত্তেজনা প্রশমন কিংবা সরাসরি বিরোধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবে আমি জোর দিয়ে যা বলতে চাই, তা হলো দুই পক্ষের কোনোটিই যুদ্ধ চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতি এখন চার ‘সি’-কেন্দ্রিক। আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে ‘থ্রি ডুজ’ (তিন ‘হ্যাঁ’) এবং ‘অ্যা ডোন্ট’ (এক ‘না’)। বিগত দশকগুলোয় এই ‘তিন সি’ দুই দেশের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন গুরুত্বের মাত্রায় তারতম্য ঘটেছে। এক দশক আগে ওবামা প্রশাসনের আমলে ‘কো-অপারেশনের’ (সহযোগিতা) ওপর জোর দেওয়া হতো। মুঠো যেই আলগা করেছে তার দিকেই হাত বাড়ানোর একটা রীতি ছিল সে সময়। এখন জোর দেওয়া হচ্ছে ‘কমপিটিশন’ (প্রতিযোগিতা) এবং ‘কনফ্রন্টেশনের’ (বিরোধ) ওপর। আমি এই দুই শব্দের পরিবর্তন কেন হলো সে সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে পারি। এখানে শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের দোষ দিয়ে লাভ নেই।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিছু নীতি গ্রহণ করেছিলেন, আর কিছু পন্থা। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। তবে ট্রাম্প হয়তো অতটা বন্ধুবৎসল ছিলেন না, মনোযোগ আর সমানুভূতি দিয়ে কথা বলতেন না, তবে তাঁর রোগনির্ণয় ও পরামর্শপত্র সঠিক ছিল। চীন প্রতারণার আশ্রয় নেয় এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়। দুই দেশই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখায়।
প্রেসিডেন্ট ওবামা সঠিক নীতি নিয়েছিলেন, কিন্তু চীন ছিল ভুল পথে। ওবামার এই নীতি দেং জিয়াওপেং-এর ধ্যানধারণার সঙ্গে যেত। চীন এই ধারণা পরিত্যাগ করেছে। ঢাকঢোল না পিটিয়ে সামর্থ্য বাড়ানোর নীতি থেকে সরে এসে চীন এখন উলফ ওয়ারিয়র বা আক্রমণাত্মক খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই। প্রতিবেশী দেশগুলোর মনে এই ধারণা দেওয়া যে চীন একটি বৃহৎ রাষ্ট্র, তার প্রতিবেশীরা নয়।
সম্মিলিত নেতৃত্ব এবং আরেকজন মাওকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য বয়স নির্ধারণের বিষয়টিও উঠে গেছে এখন। নতুন মাও সারা জীবনের জন্য সম্রাট হয়ে বসে আছেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বিড়ালের রং সাদা না কালো সে প্রশ্নও আর উঠছে না। এখন বিবেচ্য একটি বিষয়ই, তা হলো সি চিন পিং-এর আদর্শ সে বিড়াল মানে কি না।
শুধু ধনী হওয়াই এখন আর গৌরবজনক নয়, এখন আপনার পিঠে লিখে দেওয়া হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রা। এক দেশ, দুই নীতি, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি অনুসরণের বাধ্যবাধকতার কারণে হংকং-এর মানুষ যে মৌলিক স্বাধীনতা ভোগ করত সেগুলোও এখন বাতিল হয়ে গেছে। বেইজিং এগুলোকে এখন বলছে কাগুজে নীতি।
এ ধরনের ব্যবস্থাকে নিজেদের জন্য গ্রহণযোগ্য মনে করে তাইওয়ানের শূন্য শতাংশেরও কম মানুষ। এদিকে তাইওয়ান স্ট্রেট চুক্তি যা কিনা সম্পাদিত হয়েছিল দুর্ঘটনামূলক বিরোধ ঠেকাতে, সেটা এখন সুদূর পরাহত। কারণ প্রায় প্রতিদিনই পিএলএ এয়ার ফোর্স আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে, তাইওয়ানের ওপর দিয়ে মিসাইল ও ড্রোন ওড়ানোর কথা না হয় বাদই দিলাম।
চীনে আমাদের সহকর্মীরা বিষয়টি অবশ্য আলাদাভাবে দেখেন। বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে, ওয়াশিংটন হলো সব নষ্টের গোড়া। আমি হয়তো ওয়াশিংটনের কোন কাজগুলো আরও ভালো ও আলাদাভাবে করা উচিত ছিল সে সম্পর্কে একটি তালিকা বানাতে পারব, কিন্তু চীনে আমাদের সহকর্মীরা পারবেন না বা চান না। করলে তা সি চিন পিং-এর বিরুদ্ধে যাবে, আর এতে ক্যারিয়ারের বারোটা বাজবে।
চীনের কার্যক্রম যে সমস্যাজনক সেটা শনাক্ত করতে না পারলে সমাধানও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটা উদাহরণ দিই। দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যে একটি বিতর্কিত প্রবালপ্রাচীরের ওপরে দ্বীপ বানিয়ে নিয়েছে চীনারা। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে তারা এই দ্বীপের ১২ মাইল এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করে কোনো জাহাজ বা উড়োজাহাজ ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন অমান্য হয় না এমন যেকোনো জায়গায় জাহাজ ও উড়োজাহাজ পাঠাতে চায়। তাই তারা চীনের এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করছে।
কিন্তু আমার চীনা সহকর্মীরা বলছে যুক্তরাষ্ট্রের এই যেকোনো স্থানে জাহাজ ও উড়োজাহাজ পরিচালনার ইচ্ছাটাই সমস্যা তৈরি করছে। অথচ সি চিন পিং ওবামাকে কথা দিয়েছিলেন, এ অঞ্চলে তিনি সেনা মোতায়েন করবেন না।
কনফারেন্সের আয়োজকেরা জানতে চান যেসব বিষয়ে দুই দেশের আগ্রহ আছে সেগুলোও এমন ঝুঁকির মধ্যে টিকবে কিনা। ওয়াশিংটন তাই আসা করে। সে কারণে প্রেসিডেন্টের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত এবং রাজস্ব বিভাগের মন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বেইজিং-এ অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা যায় কি না, সে নিয়ে আলোচনা করতে সফর করেছেন।
কোরিয়া উপদ্বীপে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের আকাঙ্ক্ষা দুই দেশেরই আছে। তারপরও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আইনি বাধ্যবাধকতা পিয়ংইয়ং অস্বীকার করে আসছে এবং চীন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর কীভাবে চলা উচিত? উত্তর হলো, খুব সাবধানে। দেশগুলো হয়তো নিজ নিজ স্বার্থ দেখবে। কিন্তু তাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত, তারা যদি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানার পরও রাশিয়াকে নিন্দা করতে না পারে, তাহলে আরও যারা আইনকানুন ভাঙার পথে আছে তাদের প্রতি দেশগুলোর মনোভাব কী হবে? পিটার দ্য গ্রেট শো-এর আমলে ইউক্রেন রাশিয়ার সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। পুরো মধ্য এশিয়া, যা স্ট্যান নামে পরিচিত পায়, সেগুলো একসময় জাররা নিয়ন্ত্রণ করত। তাহলে তাদের পরবর্তী গ্রাস হতে চলেছে কোন দেশ?
র্যালফ কজা প্যাসিফিক ফোরামের প্রেসিডেন্ট এমিরেটাস
প্যাসিফিক ফোরামে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত।