সেই স্বপ্নরাজ্যে আমরা কীভাবে পৌঁছাব

নানা দিক থেকে কঠিন সময়ে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নতুন সরকারের। নতুন প্রজন্মের ও দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শিক্ষায় দূরদর্শী নেতৃত্বের ওপর।

শিক্ষার প্রসার ও অগ্রগতি হয়েছে সংখ্যার দিক থেকে সব শিশুর জন্য ভিত্তিমূলক বিদ্যালয় শিক্ষা, উচ্চতর শিক্ষা ও কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষায় যে গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন, তা ঘটেনি। সরকারি খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও পরিবারকে বড় অঙ্ক ব্যয় করতে হয় প্রাইভেট টিউটর ও কোচিং, নানা রকম পরীক্ষার ফি ও বিদ্যালয় আয়োজিত নানা কাজের জন্য। মাধ্যমিক স্তরে বিনা খরচায় শিক্ষাসেবার প্রতিশ্রুতি নেই। এই স্তরে পরিবারের ব্যয় অনেক বেশি।

শিশু শিক্ষার কেমন সুযোগ পাবে, তা বাজারের যেকোনো পসরার মতো পরিবার কত ব্যয় করতে পারবে, তা দিয়ে স্থির হয়। শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের বর্ধমান বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেওয়ার অস্ত্র হয়ে গেছে।

২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে কিছু আপস সত্ত্বেও দেশ গঠনের উপযোগী মানসম্মত শিক্ষার এক রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এর এক প্রধান উপাদান ছিল সব শিশুর জন্য সমমানের একই ধরনের বিদ্যালয় শিক্ষার ব্যবস্থা। এই রূপরেখা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কোনো কর্মপরিকল্পনা বা সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এই জটিল কাজের তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনার জন্য এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিধিবদ্ধ স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ ছিল শিক্ষানীতিতে। এসব কিছুই হয়নি প্রায় দেড় দেশকে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন প্রজন্মের অধিকাংশ শিশু ভিত্তিমূলক জ্ঞান ও দক্ষতা—অর্থাৎ পড়া, লেখা ও গণিতের চার প্রক্রিয়া আয়ত্ত করতে পারছে না। দক্ষতার এই ভিত্তি পরবর্তী স্তরের শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে সফল হওয়ার জন্য অপরিহার্য। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ অন্য নিম্ন আয়ের দেশের মতো এক শিক্ষা-দারিদ্র্যের আবর্তে পড়ে গেছে। খণ্ডিত, আংশিক, রোগের মূলে না গিয়ে উপসর্গ ধরে বিধান এবং সমন্বিত ও সামাগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের অভাব নানাভাবে শিক্ষার প্রকৃত অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

এক. ভিত্তিমূলক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষা সব শিশুর অধিকার। এই দায়িত্ব দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিভাজিত থাকার একটি সামগ্রিক ও সমন্বিত কার্যক্রম এখনো গ্রহণ করা যায়নি।

দুই. চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী ও দুই লক্ষাধিক প্রতিষ্ঠানের অতিকেন্দ্রায়িত মাথাভারী শাসন স্থানীয় আবহ ও প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যকর ও জবাবদিহি সেবাদানে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতি এলাকায় শিশুর জন্য গ্রহণযোগ্য মানের বিদ্যালয় শিক্ষার এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও সম্পদের সংস্থান প্রয়োজন।

তিন. গ্রহণযোগ্য মানের শিক্ষার জন্য যথেষ্ট বিনিয়োগ প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সীমিত সম্পদের দোহাই ধোপে টেকে না। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীসহ অন্য দরিদ্র দেশ শিক্ষার্থীপ্রতি আমাদের গড় ২০০ ডলার সরকারি ব্যয়ের অন্তত দ্বিগুণ ব্যয় করে। বাংলাদেশে সরকারি বিনিয়োগ আনুপাতিক হারে বাড়ার পরিবর্তে কমে আসছে। বিকেন্দ্রায়িত জবাবদিহি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সম্পদের যথার্থ ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষায় সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও এক সমন্বিত মেগা উদ্যোগে নেতৃত্ব এখন সময়ের দাবি। এই উদ্দেশ্যে দুটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে—শিক্ষাকে এক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা এবং সামগ্রিক দিকনির্দেশনার জন্য ও নজরদারির জন্য এক বিধিবদ্ধ উচ্চক্ষমতার স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন। শিক্ষার রাষ্ট্রীয় ভূমিকাকে সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে রাখা হতে হবে শিক্ষার নেতৃত্বে এক প্রধান অ্যাজেন্ডা

চার. শিক্ষায় প্রযুক্তির কথা অনেক বলা হলেও এর অবকাঠামো, সংযুক্তি, সরঞ্জাম, মেরামতি ও সেবা চালু রাখার চলতি ব্যয়, বাংলায় শিক্ষাক্রমের সঙ্গে মিলিয়ে প্রযুক্তিভিত্তিক বিষয়বস্তু এবং শিক্ষকের যথার্থ প্রস্তুতি ও তাঁকে সহায়তা—এ সবিছুতেই অনেক ঘাটতির কারণে শ্রেণিকক্ষের পাঠ ও প্রযুক্তিভিত্তিক পাঠের সমাহার ঘটানো যায়নি। বরং বিত্তবান পরিবারের শিশুদের প্রযুক্তির ব্যবহার ও অন্যদের বঞ্চিত থাকার নতুন বৈষম্য তৈরি হয়েছে।

পাঁচ. শিক্ষকের যোগ্যতা, দক্ষতা ও পেশাদারির ওপর নির্ভর করে শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীর কৃতী। শিক্ষকের সংখ্যা ও দক্ষতা উভয় ক্ষেত্রেই বড় ঘাটতি শিক্ষা উন্নয়নের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করছে। অথচ এ বিষয়ে গতানুগতিক ভাবনার বাইরে মেধাবী তরুণদের শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রস্তুত করে ধরে রাখার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

ছয়. এসব ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তা বা সিদ্ধান্তহীনতা রাজনৈতিক ব্যর্থতার নিদর্শন। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের বিবেচনা শিক্ষা রূপান্তরে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর স্বার্থ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রধান বিবেচ্য হতে হবে।

খণ্ডিত, আংশিক ও উপসর্গ ধরে বিধানের এক উদাহরণ সম্প্রতি শুরু করা শিক্ষাক্রম প্রকল্প। এই উদ্যোগের মূল প্রতিপাদ্য—গাইড বই মুখস্থ, প্রাইভেট পাঠদান ও পরীক্ষা-প্রাধান্যের পরিবর্তে শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের সঙ্গে দলীয় কাজ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সানন্দে পাঠের বিষয়বস্তু শিখবে ও নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন করবে। বর্তমান পরীক্ষা-আধিক্য থাকবে না, প্রাইভেট পাঠদান ও কোচিংয়ের সুযোগ থাকবে না, শিক্ষার্থী মূল্যায়নে নম্বর-গ্রেডিং থাকবে না। শিক্ষক প্রতি শিক্ষার্থীর অগ্রগতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করবেন এবং শিক্ষকের ধারাবাহিক মূল্যায়ন বছর শেষে বা পাবলিক পরীক্ষার সামষ্টিক মূল্যায়নে যোগ হবে। (শুধু দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা থাকবে।) এই উদ্দেশ্যে পাঠ্যপুস্তক তৈরি হচ্ছে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এভাবে নতুন প্রজন্ম চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী দক্ষ কর্মী ও চৌকস মানুষ হিসেবে বড় হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বপ্নরাজ্যে আমরা কীভাবে পৌঁছাব? শিক্ষক ও বিদ্যালয়কে যে গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা পালনে তাদের সক্ষমতা কতখানি?

যে প্রতিপাদ্য ও লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও এসব সর্বজনীনভাবে প্রবর্তিত হয়নি। এগুলোকে ধারণাগত অভীষ্ট হিসেবে দেখা হয়। যদিও তাদের বিদ্যালয় ও শিক্ষকের সক্ষমতা বহুগুণ এগিয়ে। সেখানেও অঙ্কের নামতা, বর্ণলিপির ধ্বনি, বীজগণিতের জন্য অনুশীলন ও মুখস্থ করা বিলুপ্ত হয়নি। শিক্ষা ও শিক্ষাক্রমের কার্যকর সংস্কার ও রূপান্তরের জন্য ওপরে যেসব বিষয়ের কথা বলা হলো, সেগুলোতেও যথার্থ পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিক্ষায় সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও এক সমন্বিত মেগা উদ্যোগে নেতৃত্ব এখন সময়ের দাবি। এই উদ্দেশ্যে দুটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে—শিক্ষাকে এক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা এবং সামগ্রিক দিকনির্দেশনার জন্য ও নজরদারির জন্য এক বিধিবদ্ধ উচ্চ ক্ষমতার স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন। শিক্ষার রাষ্ট্রীয় ভূমিকাকে সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে রাখা হতে হবে শিক্ষার নেতৃত্বে এক প্রধান অ্যাজেন্ডা।

● ড. মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস ও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিশু বিকাশ নেটওয়ার্কের সভাপতি