স্নাতক শেষ করেই উচ্চশিক্ষার জন্য আমাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছিল। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক কোনো সমাবর্তনে আমি অংশগ্রহণ করতে পারিনি। তবে দেশের বাইরে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শেষ করায় দুটি সমাবর্তনে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। এই সব সমাবর্তনে অংশ গ্রহণের জন্য আমাকে অতিরিক্ত একটি পয়সা দিতে হয়নি। এমনকি সনদ নেওয়ার জন্য একটি পয়সা দিতে হয়নি। বরং এই সব সমাবর্তনে অংশ নিতে গ্র্যাজুয়েটদের বাবা-মাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
অথচ এই সমাবর্তনে অংশ নিতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ‘নিবন্ধন ফি’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের ব্যবসা চালু করে রেখেছে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে একজন শিক্ষার্থী যখন চাকরির আবেদনে ব্যস্ত ঠিক তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আনুষ্ঠানিক সনদ দেওয়ার নাম করে হাজার হাজার টাকা গ্র্যাজুয়েটদের কাছ থেকে আদায়ের ‘প্রথা’ চালু করে রেখেছে। ফলে এই সব সমাবর্তনে অংশ নেওয়ার জন্য মোটা দাগের নিবন্ধন ফি জোগাড় করতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেরা স্বাদ নেওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।
এঁদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ওসমান গনি। ২৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বগুড়ার সোনাতলার দিনমজুর বুলু আকন্দের সন্তান ওসমান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ৫৩তম সমাবর্তনের জন্য ৪ হাজার ৩০০ টাকা জোগাড় করতে না পারায় অংশ নিতে পারেননি। শুধু ওসমান নন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে অনেক শিক্ষার্থীকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপিয়ে দেওয়া এই নিবন্ধন ফি জোগাড় করতে না পারায় বন্ধুদের নিয়ে একসাথে সনদ হাতে ফ্রেমবন্ধী হওয়া থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। কিন্তু কেন আমাদের ছেলেমেয়েরা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সুখকর স্মৃতি ধরে রাখতে কয়েক ঘণ্টার জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা গুনবে? বার্ষিক লাখ টাকা যখন সরকার মাথাপিছু ব্যয় করছে, ঠিক তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন তাঁদের কাছ সনদ দেওয়ার অনুষ্ঠানের নামে এই টাকা আদায়ের দোকান খুলে বসে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ৫৩তম সমাবর্তনের জন্য গত ৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধকারের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি থেকে জানায় যায়, স্নাতকে ৩ হাজার, স্নাতকোত্তরে ৪ হাজার, পিএইচডির জন্য ৫ হাজার আর সান্ধ্যকালীনের স্নাতকোত্তরধারীদের জন্য ৭ হাজার টাকা কেবল নিবন্ধন ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর সাথে অতিরিক্ত তিন শ টাকা মূল সনদ উত্তোলনের জন্য গ্র্যাজুয়েটদের গুনতে হয়।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, চার বছর আগে ৫০ ও ৫১তম সমাবর্তনের চেয়ে ৫৩তম সমাবর্তনে এক থেকে দুই হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫১তম সমাবর্তনের বিজ্ঞপ্তিতে, স্নাতকে ২ হাজার, স্নাতকোত্তরে ৩ হাজার, পিএইচডিতে সাড়ে ৩ হাজার এবং সান্ধ্যকালীন স্নাতকোত্তরধারীদের ৫ হাজার টাকার নিবন্ধন ফি ধার্য করা হয়েছিল। সেই সময়েও মূল সনদের জন্য আরো তিন শ টাকা দিতে হয়।
এই সব সমাবর্তনের নিবন্ধন ফির বিপরীতে গ্র্যাজুয়েটদের দেওয়া হয় একখানা আমন্ত্রণপত্র, সমাবর্তনে অংশ নেওয়ার জন্য পোশাক আর উপহার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের জন্য খোলা ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, এবারের ৫৩তম সমাবর্তনে অংশগ্রহণের জন্য আবেদনকারী ছিল ৩০ হাজার ৩৪৮ জন। এই সংখ্যাটিকে গড় হিসেবে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ধরে তাঁদের থেকে নেওয়া নিবন্ধন ফি হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল এই সমাবর্তনের জন্য ১ কোটি ২১ লাখ টাকা পেয়ে যায়। সমাবর্তনের পর পোশাক ফেরত নিয়ে নেওয়ার পরও, ঠিক কোন অজুহাতে এই মোটা দাগের নিবন্ধন ফি আদায় করা হয়, আর কেনই বা বছর বছর নিবন্ধন ফি বাড়ানোতে স্বেচ্ছাচারিতা তা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভালো বলতে পারবে।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই সব চড়া মূল্যের নিবন্ধন আদায় করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে, যখন আমাদের ছেলেমেয়েরা তো সবাই চাকরি পেয়ে যায় না, বরং চাকরির পেছনে আবেদন ফিতে তাঁদের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠে। অথচ সনদ নেওয়ার অনুষ্ঠানের জন্য কয়েক হাজার টাকা বেকার গ্র্যাজুয়েটদের কাছে বিষফোড়া বটে।
তবে মাসিক ১২ থেকে ১৫ টাকা বেতন দিয়ে পড়া একজন শিক্ষার্থীর পেছনে যখন সরকার বার্ষিক ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা ব্যয় করে আসছে, তখন সেই শিক্ষার্থীকে চার বছরের স্নাতক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে ৫৭৬ টাকা বেতন দিতে হয়, সেখানে সেই সনদ নেওয়ার সমাবর্তনে স্নাতকের বেতনের ৬ গুণ নিবন্ধন ফি আদায় করার যৌক্তিকতা আমি অন্তত খুঁজে পাই না।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজনের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই সব চড়া মূল্যের নিবন্ধন আদায় করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে, যখন আমাদের ছেলেমেয়েরা তো সবাই চাকরি পেয়ে যায় না, বরং চাকরির পেছনে আবেদন ফিতে তাঁদের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠে। অথচ সনদ নেওয়ার অনুষ্ঠানের জন্য কয়েক হাজার টাকা বেকার গ্র্যাজুয়েটদের কাছে বিষফোড়া বটে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সমাবর্তনে অংশ গ্রহণের জন্য তো গ্র্যাজুয়েটধারীদের বাধ্য করা হয় না, স্বেচ্ছায় যাঁরা আনুষ্ঠানিক সনদপত্র গ্রহণ করতে আগ্রহী তাঁরা টাকা খরচ করতে পারলে কর্তৃপক্ষের সমস্যা কোথায়? যাঁদের নিবন্ধন ফি দেওয়ার সক্ষমতা নেই, তাঁরা অনুষ্ঠানে যোগদান না করে, কেবল সনদ ফি ৩০০ টাকা দিয়ে সনদপত্র নিলে পারে?
হ্যাঁ, ওসমান গনিদের মতো ছেলেমেয়েরা হয়তো সমাবর্তনে অংশ না নিয়ে সনদপত্র নিয়ে ক্ষান্ত থাকতে পারে, তবে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে সবচেয়ে আনন্দময় দিন হলো এই সমাবর্তন। এই অনুষ্ঠান থেকে ওসমান গনিদের বঞ্চিত রাখা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবহির্ভূত আচরণ, যা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং সবাইকেই আনুষ্ঠানিক সনদ দেওয়ার রীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য।
কোটি টাকার অনুষ্ঠানের আয়োজন কখনোই যৌক্তিক পর্যায়ে পড়ে না। সমাবর্তন বক্তার নামে লাখ টাকা বাজেটও বিলাসিতার মধ্যে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নির্ধারিত সময়ে স্নাতক/স্নাতকোত্তর শেষ করে শিক্ষার্থীদের হাতে সনদ তুলে দেওয়া, সনদ তুলে দেওয়ার নামে পকেট কাটা শোভনীয় হতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন বলতে পারবে, ঠিক কোন কোন খাতে সমাবর্তনের এই নিবন্ধন ফি ব্যবহৃত হয়? ঠিক কোন যুক্তিতে প্রতি বছর নিবন্ধন ফি বাড়ানো হয়? এই খরচের কৈফিয়ত যখন বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হয়, তখন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শেষ মুহুর্তকে বিমূর্ত করার হেতু আমি অন্তত দেখতে পাই না।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়তো ভুলে যায়, যে শিক্ষার্থী ১২ টাকা মাসিক বেতনে পড়ছে, যে শিক্ষার্থী ২৫ টাকায় আবাসিক হলে খাবার খাচ্ছে, সেই শিক্ষার্থীর হাতে সনদ তুলে দেওয়ার নাম করে, বছরের পর বছর ‘সমাবর্তন ব্যবসা’ অন্তত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানায় না। বরং সরকার যখন উদারতা দেখিয়ে একজন শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার জন্য লাখ টাকা বার্ষিক খরচ করতে দ্বিধা করছে না, তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আয়ের খাত হিসেবে সমাবর্তনকে বেছে নিয়ে পক্ষান্তরে সরকারের উচ্চশিক্ষা নীতির বিরুদ্ধাচরণ করছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে ১৫ টাকা মাসিক বেতনে পড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠের সুযোগ করে দিয়েছে এই দেশের জনগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল গ্র্যাজুয়েটদের হাতে সনদ দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হওয়া উচিত। সরকার যদি লাখ টাকা খরচ করতে পারে, তাহলে এই সব সনদ বিতরণের আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানের ব্যয় সরকারের কাঁধে নিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
বরং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হবে, গ্র্যাজুয়েটদের এই সব সনদ দেওয়ার অনুষ্ঠানে ওসমান গনিদের দিনমজুর বাবা-মাদের আমন্ত্রণ জানানো। রিকশাচালক পিতাকে মঞ্চের সামনে বসানো। নামি-দামি বিদেশি সমাবর্তন বক্তাদের পাশাপাশি পারলে এই সব চা-দোকানি বাবাদের সমাবর্তনে ডেকে তাঁদের সংগ্রামের কথা শুনুন, গৃহকর্মী মায়ের সন্তানের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার গল্প জানুন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মনে রাখতে হবে, এই সব মা-বাবা যেভাবে সন্তানকে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, যে সংগ্রাম করে সন্তানদের জন্য ওই সনদ বাগিয়ে আনছেন, তাঁরা আমাদের সমাজের প্রকৃত আলোকবর্তিকা, যাঁদের স্বপ্নে এই শহরটা এখনো ঝলমল করছে, সেই মানুষদের জন্য সমাবর্তনস্থলে আসন পেতে দেওয়া হতে পারে ভালোবাসার, পরম উদারতার।
আমার বিশ্বাস, সরকার অচিরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘সমাবর্তন ব্যবসা’ বন্ধ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক আয়ের বাড়তি খাত হিসেবে না দেখে সমাবর্তনকে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের শেষ অনুষ্ঠানটি আনন্দময় করার সুযোগ দেবে। প্রয়োজনে এমন সমাবর্তন আয়োজনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক বাজেটের পথ উন্মুক্ত করে দিতে পারেন।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]