৩ মার্চ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণার উপস্থাপনা ও আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তরুণ, অমায়িক ও বিনয়ী শিক্ষামন্ত্রী খোলামেলা তাঁর আশা, সংকল্প, উদ্বেগ ও সমস্যার কথা বললেন।
নিজের স্কুলজীবনের কথা স্মরণ করে জানালেন, তাঁর পিতা (প্রয়াত চট্টগ্রামের খ্যাতনামা জননেতা) নামকরা স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিংয়ের জোরেই নামকরা স্কুল নাম কামায়। একবার নাম হয়ে গেলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সেখানে ভিড় জমায় এবং স্কুল যা-ই করুক, নামকরা স্কুলের নাম বহাল থাকে। প্রতিটি এলাকায় সব শিক্ষার্থীর জন্য গ্রহণযোগ্য মানের বিদ্যালয় ছিল না, এখনো তা হয়নি।
দীর্ঘ সময় শিক্ষামন্ত্রীর শিক্ষাজীবন ইংল্যান্ডে কেটেছে। তাঁর বক্তব্য, সেখানে সরকারি বিদ্যালয়ে যেভাবে পড়ানো হয় ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করা হয়, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মডেল বিদেশে চালান করে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজ, এডেক্সেল ইত্যাদি বাণিজ্যিক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোচিং সেন্টারভিত্তিক ও মুখস্থনির্ভর এক পদ্ধতি চালু করে আন্তর্জাতিক ছাপ লাগিয়ে এগুলোকে জনপ্রিয় করা হয়েছে। বিত্তবান ও অনেক ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা ইংরেজি মাধ্যমের এই শিক্ষায় অংশ নেয়।
আসলে মেধার ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কতখানি হয়, সে প্রশ্ন থেকে যায়। জন্মগতভাবে মেধার গুণে ও বিত্তবান পরিবারের চেষ্টায় অনেক শিশু এই ইংরেজি মাধ্যম থেকে ভালো ফল করে সাফল্য অর্জন করছে। বিদ্যালয় ও শিক্ষাপদ্ধতির কৃতিত্ব কতখানি, এতে তা বলা যায় না। সমাজে বৈষম্য ও বিভাজন সৃষ্টি এর এক ক্ষতিকর দিক।
দেশের শিক্ষাবিদদের অনেকেই যেসব সমস্যা তুলে ধরেছেন, সেসবের প্রতিধ্বনি শোনা গেল শিক্ষামন্ত্রীর স্পষ্ট কথায়। শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, দেশে ধর্মীয় মৌলবাদের কথা এবং কীভাবে শিক্ষাকে মৌলবাদী রাজনীতির হাতিয়ার করার চেষ্টা চলছে। এই কারণে যেকোনো সামান্য বিষয় বা ভিন্নমতকে বড় করে মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও অনুভূতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে।
এভাবেই লিঙ্গ পরিচয়ের মানসিক ও শারীরিক অভিব্যক্তি বা ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের পাঠ অথবা ইতিহাসের কোনো বিষয়ের উপস্থাপনা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর কথা, এসব ব্যাপারে সরকারপ্রধান, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অবস্থান স্পষ্ট ও আদর্শভিত্তিক। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির স্তম্ভ চতুষ্টয়ের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক ও মানুষের মর্যাদা রক্ষাকারী জাতির ও ব্যক্তির বহুমাত্রিক পরিচয় সমুন্নত রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর। শিক্ষায় এই দর্শন ও আদর্শ প্রতিভাত হতে হবে।
সরকারের শিক্ষায় অগ্রাধিকারের উদাহরণ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বললেন, ২০০৫-০৬ সালে পুরো জাতীয় বাজেট যা ছিল (৬৬ হাজার কোটি টাকা), ২০২৩-২৪ সালে শুধু শিক্ষার জন্য তার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি (৮৮ হাজার কোটি টাকা) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাঁর না জানার কথা নয় এই সংখ্যায় সরকারি ব্যয়ের আর্থিক বরাদ্দের আসল অগ্রাধিকার প্রকাশ পায়নি। আনুপাতিক হারে শিক্ষা ব্যয় জাতীয় আয়ের ২ শতাংশের নিচে রয়ে গেছে, যা সারা পৃথিবীতে অন্যতম সর্বনিম্ন হার।
তার চেয়ে বড় কথা, শিক্ষার অবয়ব বেড়েছে গত দুই দশকে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তাই মূল্যস্ফীতি ধরলে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারি গড় ব্যয় (আনুমানিক ২০০ ডলার) স্থবির হয়ে আছে। আমরা স্বল্প খরচে শিক্ষার পরিসর বাড়াতে গিয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে বড় মূল্য দিচ্ছি।
সরকারি জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণি শেষ করেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ব্যবহারিক ভিত্তিমূলক সাক্ষরতা (সহজ এক ভাষ্য পড়তে ও লিখতে পারা) ও গণিতের দক্ষতা অর্জন করছে না। বিশ্বব্যাংক বলছে, আমরা (অন্যান্য অনেক নিম্ন আয়ের দেশের মতো) ‘শিক্ষা দারিদ্র্যের’ ফাঁদে পড়ে গেছি; যা থেকে বেরোনো যাচ্ছে না।
মোদ্দাকথা, গ্রহণযোগ্য মানের সব শিক্ষার্থীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি বাড়াতে হবে এবং এই বিনিয়োগকে যথার্থ কাজে লাগাতে হবে। সে ক্ষেত্রেও অনেক দুর্বল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতির ব্যাপ্তি। জবাবদিহির অভাব ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে ব্যাপক আকারে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা উপযুক্ত, দক্ষ, নিবেদিত শিক্ষকের সংখ্যা ও যোগ্যতা নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান গুণগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বহুদিনের পুঞ্জীভূত ও বহুমুখী সমস্যার সমাধানের চেষ্টায় স্বচ্ছ ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বল নেতৃত্বের বিষয়ে শিক্ষা পর্যালোচকেরা কথা বলেছেন।
শিক্ষাকে গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে রাখা কি সম্ভব হবে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অতীত ও বর্তমানে শাসক দলের তোষণে ও পোষণে তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির অনাচার শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এমনকি যৌন নির্যাতন লজ্জাকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিক্ষকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন এবং জড়াতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এক অর্থে আস্তাবল ঝেড়েমুছে নতুন যাত্রা শুরুর দায় শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁর সহকর্মীদের। কিন্তু এই কঠিন দায়িত্ব পালনে তাঁকে পেতে হবে সবার সহযোগিতা ও সুবিবেচনাপ্রসূত পরামর্শ। সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জটিল সমস্যাবলির দীর্ঘমেয়াদি ও আশু সিদ্ধান্তের বিষয়গুলোতে প্রধান অংশীজনদের নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ।
এক ক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রীর কথায় অনমনীয়তার আভাস পাওয়া যায়। নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনে দ্রুত এগিয়ে যেতে তিনি বদ্ধপরিকর; শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনেকের নানা উদ্বেগ ও প্রশ্ন সত্ত্বেও। শিক্ষাবিদদের অনেকের আশঙ্কা এ ক্ষেত্রেও শিক্ষা অগ্রাধিকারের অন্যান্য বিষয়ের মতো খণ্ডিত, আংশিক ও রোগের মূলে না গিয়ে উপসর্গভিত্তিক বিধানের নমুনা। কারণ, এদের মতে উচ্চাভিলাষী পরিবর্তনের জন্য শিক্ষক, বিদ্যালয়, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করায় আরও কাজ করা প্রয়োজন।
নতুন শিক্ষাক্রমের অভিজ্ঞতামূলক শিখন ও শেখানো উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। কিন্তু সর্বত্রই প্রত্যাশামূলক লক্ষ্য ও বাস্তব কার্যকলাপে ফারাক থাকে। আমাদের মতো দেশে এই ফারাক অনেক বেশি। তাই সাবধানে এগোতে হবে। তা না হলে সাফল্যের পরিবর্তে দুর্যোগ ঘটার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
বিশেষত শিক্ষার্থী মূল্যায়ন নিয়ে অনেক আশঙ্কার উদয় হয়েছে, যা যথেষ্ট বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, শিক্ষকের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন ও পাবলিক পরীক্ষার ফল যোগ করে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের প্রস্তাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অসম দুই বিষয়কে একত্র করে ফেলা হবে। ইংরেজিতে যা বলা হয়, আপেল ও কমলাকে মিলিয়ে ফেলা। দুটির উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি ভিন্ন। দুটিকে আলাদা রেখে মূল্যায়নপত্র তৈরি হতে পারে।
উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নিয়োগদাতারা বিদ্যালয় প্রদত্ত মূল্যায়নপত্র ও পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন নিজেদের মতো বিবেচনায় নিতে পারেন। দুটোকে একত্র করার যৌক্তিক ভিত্তি নেই এবং তা অন্যান্য দেশে প্রচলিত বলেও জানি না।
এডুকেশন ওয়াচসহ অন্যান্য সংস্থার পর্যালোচনাসহ শিক্ষাবিদদের অনেকেরই মত, সামগ্রিক শিক্ষা খাতভিত্তিক (এসডিজি ৪, রাষ্ট্রের ২০৩১ ও ২০৪১ লক্ষ্য সামনে রেখে) পরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন, দীর্ঘমেয়াদি ও জরুরি পদক্ষেপ নির্ধারণ করা দরকার। ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
এ ধরনের কাজের দিকনির্দেশনার জন্য ২০১০ শিক্ষানীতিতে বিধিবদ্ধ স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের কথা বলা হয়েছিল। স্থায়ী কমিশন হলেই কি সমাধান আসবে? দেশে অনেক কমিশন ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো অকার্যকর। কাদের নিয়োগ দেওয়া হয় এই কাজে ও কাজের জন্য রাজনৈতিক সমর্থন কতখানি, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
শিক্ষাকে গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে রাখা কি সম্ভব হবে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অতীত ও বর্তমানে শাসক দলের তোষণে ও পোষণে তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির অনাচার শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এমনকি যৌন নির্যাতন লজ্জাকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিক্ষকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন এবং জড়াতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। দৃঢ় ও সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিকল্প নেই এ ক্ষেত্রে। শিক্ষায় বৈশ্বিক অগ্রগতিসংক্রান্ত গ্লোবাল এডুকেশনে মনিটরিং রিপোর্টের আগামী ২০২৪-২৫ প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু শিক্ষায় নেতৃত্বের সংকট।
এই সংকটের এক প্রধান দিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দর্শনের সংকট। আমরাও এই অবর্তে আবদ্ধ। এ থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী তাঁর লক্ষ্যে সফল হোন। বঙ্গবন্ধুকন্যার চৌকস তরুণসমাজ ও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য সফল হোক। এ জন্যই দৃঢ় ও সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বের প্রয়োজন।
● ড. মনজুর আহমদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইসিডি নেটওয়ার্কের সভাপতি ও গণসাক্ষরতা অভিযানের উপদেষ্টা