কৃষকের রেশম চাষে এমন বাধা কেন

বাঁশ-বেতের তৈরি বিশেষ ধরনের পাত্রে এভাবে রেশম পোকাকে খেতে দেওয়া হয়েছে তুঁতপাতাছবি: প্রথম আলো

আঠারো শতকের তিরিশের গোড়া থেকে ইংরেজ কোম্পানি কুমারখালী ও রংপুরের রেশম রপ্তানি শুরু করে দেয়। তার আগে ১৬৭০ সালের দিকে ডাচরা এই রেশম রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলার রেশম ইরান ও চীনের চেয়ে সস্তা। ফলে লাভ হতো বেশি। এ কারণে ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো বাংলার রেশম–বাণিজ্যে ঝুঁকে পড়ে। ১৭৫৭–এর আগে বাংলায় বিশ্বের মোট রেশমের আট ভাগ উৎপাদিত হত। মেদিনীপুর, রাজশাহী, রংপুরসহ সারা বাংলায় নানান ধরনের রেশম চাষ হতো। সেই রংপুর কীভাবে দারিদ্র্যের শীর্ষে পৌঁছে গেল?

এক.

রংপুরের দখিগঞ্জ শ্মশানের পাশে রংপুর তুঁত বোর্ড। প্রধান কর্মকর্তার অফিস দেখতে চাইলে দারোয়ান নতুন বড় ভবনটি দেখালেন। একজন নারী নিজেকে স্বেচ্ছাসেবক পরিচয় দিয়ে বললেন, সবাই ছুটিতে আর উপপরিচালক ডিসি অফিসে মিটিংয়ে। ওই ভবন থেকে বেরিয়ে সামনের পুরোনো একতলা ভবনে গেলাম। একজন কর্মকর্তাকে পেলাম। জানলাম, চাইলেই যে কেউ রেশম চাষ করতে পারবেন না। যখন রেশম বোর্ড প্রকল্পের নামে বাজেট পাবে, তখন তারা নিবন্ধিত কৃষকদের চারা, লার্ভা ও উৎপাদনের পুরো খরচ দেবে। চারা লাগানোর জন্য দুবারে মোট ২৫ হাজার ও ঘর তোলার জন্য ১ লাখ টাকা দেবে। একজন নিবন্ধিত কৃষকও চাইলে এক বিঘার বেশি রেশম আবাদ করতে পারবেন না। একজন কৃষককে মাত্র এক বিঘা জমির জন্য যতটুকু রেশম পোকার লার্ভা লাগবে, ততটুকুই দেওয়া হবে।

রেশম দুভাবে বিক্রি করা যায়—কাঁচা রেশম ও বস্ত্রবয়ন। এর উৎপাদনব্যবস্থা একাধারে কৃষি ও কুটিরশিল্প। একসময় কৃষক মাঠে, রাস্তায় তুঁতগাছের চাষ করতেন, কৃষকবধূ ঘরে রেশম পোকা পালতেন।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে জে জিওঘেগান তাঁর সিল্ক ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে লিখেছেন, রেশম পোকা পালনের জন্য আলাদা ঘরের প্রয়োজন হতো। একটি ঘরে ২০০ কাহন বা ২ লাখ ৫৬ হাজার পোকা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পোকা পালনের এই মাচাকে ধরে রাখে বাঁশের খুঁটি আর তার তলায় থাকে পানিভর্তি একটা পাত্র, এভাবে পোকামাকড় প্রতিহত করা হয়।

যে মুহূর্তে পোকা রেশমের জন্য তৈরি হয়ে যেত, তাদের গায়ের রং ‘গ্রিনিশ’ ক্রিম থেকে লাইট অরেঞ্জ কালার হয়ে যেত। তাদের দেহ থেকে একধরনের রস নির্গত হতো। সেটিই হলো রেশম। রেশম বয়নের জন্য কৃষক বা কারিগর মাদুর, ছুরি, ঝুড়ি ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। পাটের চটের ওপর পোকাগুলোকে রৌদ্রে মেলে ধরা হয়, পাশে রাখা হয় কলসিভরা পানি।

পোকাগুলোকে মাদুরে রেখে রোদে দেওয়া হয়। তারপর অল্প রোদে শুকিয়ে রাতে ঘরে তুলে নেওয়া হতো। পোকাগুলোর দেহ থেকে ৫৬ ঘণ্টা ধরে রেশম বেরিয়ে আসত। চার বা পাঁচ দিন পর পোকাগুলো রেশমের জন্য তৈরি হয়ে যায়। বর্ষাকালে এদের শুকাতে আরও বেশি সময় লেগে যেত। কৃষক এই পোকাগুলোকে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। না হলে এগুলো ফুটিয়ে রেশম সুতা কাটা হয়।

সুতা কাটুনি পোকা থেকে যে সুতা কাটেন, তার নাম পুতনি বা পত্তনি, মোটা ও সরু সুতা একসঙ্গে কাটা হয়।

এ ছাড়া বাংলায় রেশম পোকাই শুধু নয়, রেড়িগাছ বা ভেরেণ্ডাগাছের পাতা খায় যে অ্যান্ডি পোকা, সেগুলোও রেশমগুটি উৎপাদন করত। অ্যান্ডি পোকার চাষ ভারতে হলেও বাংলাদেশে হয় না। কেন হয় না, তুঁত বোর্ডের কর্মকর্তারা জানেন না। এ ছাড়া যেসব পোকা শালপাতা, আমপাতা, পাটপাতা খেয়ে গুটি বানায়, সেগুলো গৃহপালিত নয়।

দুই.

ওই কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম, লার্ভা কেন খোলাবাজারে সবার জন্য বিক্রি হয় না? উত্তরে বললেন, লার্ভাগুলো ফ্রিজে বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়। পাল্টা জানতে চাইলাম, আগে যখন ফ্রিজ ছিল না, তখন আমাদের কৃষকেরা রেশম উৎপাদন কীভাবে করতেন?

অথচ সরকারগুলো নিজেই রেশম উৎপাদনকে মুক্ত করে না দিয়ে আটকে রেখেছে। এতে একদিকে প্রণোদনাকেন্দ্রিক অসাধু চক্র তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে আগ্রহী কৃষকেরা বেশি জমিতে আবাদ করতে পারছেন না। এতে রেশম সুতার অভাবে তাঁতিরা কাপড় তৈরি করতে না পেরে পেশা ছাড়ছেন। রীতিমতো মুমূর্ষু রোগী বানিয়ে ফেলা হয়েছে শিল্পটিকে। এর গোড়ায় সার-পানি না ঢাললে মুক্তি কীভাবে মিলবে কৃষকের? 

নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক

[email protected]