বছরের শুরুটা আমাদের জন্য আনন্দের। আর গরিবের জন্য? বছরের শুরুতেই শুরু হয়ে যায় হাত পাতাপাতি। কারও লাগবে পাঁচ হাজার, কারও দুই হাজার, কারও সাত হাজার। উন্নয়নের দেশের গরিব মানুষ যে আসলেই গরিব, বছরের শুরুতেই সেটা জানাজানি হয়। ‘ভর্তি খরচ’ নামের এক ডাকাত চেপে বসে আছে এই দেশের বেশির ভাগ মানুষের খেটে খাওয়া কাঁধের ওপর। কর্মঠ–শ্রমজীবীকে বছরের শুরুতেই ভিক্ষুক বানিয়ে দেয়।
নিউমার্কেট এলাকায় থাকে বাসাবাড়িতে কাজ করা মিনা। তাঁর দুটি মেয়ে পল্টনে এক স্কুলে পড়ে। তাঁর একটিই স্বপ্ন—মেয়েরা বড় হয়ে তাঁর মতো বাসাবাড়িতে কাজ করবে না, অফিসে চাকরি করবে। অথচ নগরের সব এলাকায় পর্যাপ্ত সরকারি স্কুল নেই, আর থাকলেও সবখানে একই কাহিনি—‘সরকারি স্কুলে কিছু পড়ায় না’!
স্বল্প আয়ের এই মা–ও বাচ্চাদের কষ্ট করে আধা সরকারি স্কুলে পড়ান, প্রতিটি বিষয়ে কোচিং করান। দুই মেয়ের কোচিংয়ের জন্য মাসে তাঁর খরচ হয় ১৫০০ টাকা। বছরের শুরুতে মেয়েদের ভর্তি ফি ও পাঠ্যবইয়ের বাইরে বাধ্যতামূলক কয়েক হাজার টাকার গাইড বই, নতুন জামার খরচ, এসব চিন্তায় রাতে ঠিকমতো তিনি ঘুমাতে পারেন না। যাঁর মাসিক আয় নয় হাজার টাকা, ঘর ভাড়া ছয় হাজার টাকা, কোচিংয়ের খরচ দেড় হাজার টাকা, বছরের শুরুতে কী হাল হয় তাঁর?
‘দিন আনি দিন খাই’ পরিবারগুলো কেমন করে, কোথা থেকে স্কুলের বাড়তি খরচের জোগান দেয়? অথচ উন্নয়নের রঙিন চশমা পরা লোকেদের আপনি দেখিয়ে দিন গড়পড়তা মানুষের এই ভীষণ বিভীষিকার জীবন, তাঁরা কী বলবেন বলুন তো? বলবেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তো দ্বিগুণ হয়েছে, তাই বুয়ার বাচ্চাও কোচিং করে।
সরকারি স্কুলে পড়লে খরচ থাকার কথা নয়; কিন্তু এই দেশের বাস্তবতা হলো, বহু সরকারি স্কুলে মাসের পর মাস ঠিকমতো ক্লাস হয় না। বিশেষ করে গ্রামের স্কুলগুলোতে। বাচ্চারা স্কুলে যায়, রোল ডাকা হয়, দুপুর পর্যন্ত ক্লাসে বসে থাকে, অথবা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে, তারপর বাড়ি চলে আসে। যাঁদের কিছুটা সামর্থ্য আছে, তাঁরা কোচিং করান। অথবা মাদ্রাসায় পড়ান।
আমাদের উন্নয়নের বুদ্ধিজীবীরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বুঝে ফেলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে হাজার হাজার প্রোগ্রামার তৈরির স্বপ্নও দেখে ফেলেছেন, অথচ আমাদের শহর ও গ্রামের খেটে খাওয়া বাবা ও মায়েরা সন্তানকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে গিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছেন। তা–ও তো শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
যে খেটে খাওয়া নারী ৫০০০ টাকা বেতন পান এবং একা সংসার টানেন, প্রতি মাসে তাঁর বেতনের ৫ ভাগের ১ ভাগ চলে যায় গ্রামে রেখে আসা বাচ্চাটির কোচিং করাতে! উপবৃত্তির কথা জিজ্ঞেস করুন, বলবেন, ওটা সবাই পায় না, স্কুল কমিটি আর মেম্বারদের সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক ভালো, তাঁদের ছেলেমেয়েরা পায়। ইদানীং আবার অনেক সরকারি স্কুলে বাধ্যতামূলক কোচিং শুরু হয়েছে, বাচ্চাদের উপবৃত্তির টাকা কোচিং ফির নামে কেটে রাখা হয়। এই যে কোচিংয়ের নামে গরিবের টাকা লুটপাট, এই যে সরকারি স্কুলে ক্লাস হয় না, এই যে সরকারি স্কুলে বাচ্চা আঁটে না, এতে আমাদের ফাইভজি উন্নয়নের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না? নাকি উন্নয়ন কেবল উড়ালসড়কে আটকা?
শহরে মানুষ বাড়ছে। প্রাইভেট স্কুলের সংখ্যাও বাড়ছে। মিরপুর-আগারগাঁও এলাকায় সরকারি স্কুল বলতে শেরেবাংলা নগর, পীরেরবাগ আর গণভবন প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিপুল চাহিদা, আসন কম।
একদিকে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। রাস্তার পাশে শত শত দোকানপাট, ধুলা, ইটের স্তূপ, পার্কিং বলে আর কিছু নেই। সরু রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। বর্ষাকালে কোথাও কোমর পর্যন্ত নোংরা পানি জমে থাকে। ব্যবসার অবস্থা ভয়াবহ। আসবাবের দোকানগুলোয় দিনের পর দিন লোক নেই। অথচ এসব এলাকার ফুটপাতের হকার, মিষ্টির দোকানদার, কাপড় ব্যবসায়ী, কাঠের কারিগর, এমনকি ফল বিক্রেতাও সরকারি স্কুলে জায়গা না পেয়ে ছেলেমেয়েকে ‘মানুষ’ বানানোর অদম্য ইচ্ছায় প্রাইভেট স্কুলে দেন। এমনিতেই ৫০০ টাকা বেতন, তার ওপর আবার বছরব্যাপী কোচিংয়ের খরচ।
দীর্ঘ দিন করোনা গেল, ব্যবসায় মন্দা, এর মধ্যেই গরিবের হাড়ভাঙা খাটুনির টাকা জলের মতো খরচ হয়ে যায় বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ আর কোচিং মাস্টারের পেছনে। আছে কোনো সভ্য দেশ স্কুলে যা পড়ায়, তার কোনো দাম নেই? কোচিংয়ে যা পড়ায় সেটিই ‘অফিশিয়াল’ শিক্ষাব্যবস্থা? জানেন, এমন কোনো দেশের নাম?
খুলনার খালিশপুরে পাটকলের কাজ হারানো এক শ্রমিক শেষ পর্যন্ত তাঁর মেয়েকে আর পড়াতে পারলেন না। মেয়ে পড়ত পাটকলের আধা সরকারি স্কুলে। গত বছর অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উঠেছিল মেয়ে। ভর্তি খরচ ১৫০০ টাকা। কোত্থেকে জোগাড় হবে? মিল বন্ধ হওয়ার পর ধারদেনা করে কোনোমতে চলেছেন তাঁরা। পড়াশোনার খরচ থেকে বাঁচতে মেয়েটির বিয়ে দিলেন কাজ হারানো বাবা।
রায়ের বাজারে এক ঠিকা বুয়ার মেয়ে গ্রামের স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে। বুয়ার মাথায় হাত। মুক্তাগাছার ইচাইল নামের সেই গ্রামে কোনো সরকারি মাধ্যমিক স্কুল নেই। পঞ্চম শ্রেণি পাস করা মেয়েদের যেতে হবে পাশের গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে। রিকশাভাড়া ২৫+২৫=৫০ টাকা। মাসের অর্ধেক দিন স্কুলে গেলেও রিকশাভাড়া দিতে হবে ১০০০ টাকা! দিনে অনেক বাড়ির ঘর মোছা এই বুয়া তার খুপরি ঘরটির ভাড়া দেন তিন হাজার টাকা (রাজধানীর বস্তিবাসী প্রতি বর্গফুটে ধানমন্ডি ও বনানী এলাকার চেয়েও বেশি ভাড়া দেন)। মাসের শেষে বাড়িতে টাকা পাঠান। মেয়ের জন্য বাড়তি হাজার টাকার রিকশাভাড়া তাঁর কাছে অভিশাপের মতো লাগে। অবধারিতভাবে এ বছর থেকেই মেয়েটির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে অনেকের মতোই।
এভাবে মধ্য আয়ের দেশের মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। আর এভাবেই বিশ্বের ৪০তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ বাল্যবিবাহে চতুর্থ স্থানের গৌরব অর্জন করে।
একজন নিরাপত্তা প্রহরী জানান, তাঁর মেয়ে দশম শ্রেণিতে উঠল, ১০টা গাইড বই কিনতে হবে! একেকটা বইয়ের দাম ৪০০ টাকার কম না! ভর্তি খরচ, খেলাধুলার খরচ আর গাইড বই মিলিয়ে খরচ লাগবে সাড়ে নয় হাজার টাকা। ভদ্রলোক বেতন পান আট হাজার টাকা। একটি টাকাও সঞ্চয় নেই, সেটাই স্বাভাবিক। মাথা নিচু করে ফ্ল্যাটের মালিকদের কাছে সাহায্য চাচ্ছেন। তিনি তো একা নন। অটোরিকশাচালক, গাড়িচালক, বাসার বুয়া, ঠিকা বুয়া, কাঠমিস্ত্রি, পোশাকশ্রমিক ও মিলের শ্রমিক কেউ বাদ নেই। মানসম্মানের সঙ্গে খেটে খাওয়া এসব মানুষ বছরের শুরুতে মাথা নিচু করে হাত পাতছেন।
আর এই গাইড বই জিনিসটা কী? এ দেশের আধা সরকারি স্কুলে পড়েই তো আমরা বড় হয়েছি। গাইড বই তো কিনতে হয়নি! এখন সাত-আট হাজার টাকা বেতন পাওয়া একজন নিরাপত্তা প্রহরীকে বা একজন শ্রমিককেও এসব নিম্নমানের গাইড বইয়ের জন্য চার-পাঁচ হাজার টাকার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে! এ দেশের কয়েক কোটি ছেলেমেয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে পড়ে। সবার জন্য গাইড বই বাধ্যতামূলক! প্রশ্ন করুন, গাইড বইয়ের ব্যবসার ‘লাভের গুড়’ কে কে পান। নাম বললে চাকরি থাকবে না। এমন লোকজন জড়িত না হলে পাঠ্যবই সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলার মতো এমন উদ্ভট পরিস্থিতি কি এমনি এমনি তৈরি হয়?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আগেই পণ্য হয়েছে, এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে তিলে তিলে দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের সামর্থ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলোতে ক্লাস হয় না। কোচিং না করলে পাস হয় না। গ্রামগঞ্জে নবম–দশম শ্রণিতে উঠলেই মেয়েদের বিয়ের হিড়িক পড়ে যায়। গ্যারেজে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী লোকটি ঘামের বেতন নিংড়ে, পর্বতপ্রমাণ খরচের বোঝা টেনে টেনে নিজের মেয়েটিকে অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে চান।
আর এই ‘ভর্তির খরচ’ জিনিসটাই–বা কী? চতুর্থ থেকে পঞ্চমে উঠতে দুই হাজার টাকা, পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠতে আড়াই হাজার টাকা, ভর্তির খরচের নামে লাগামহীন লুটতরাজ চলছেই। অবশ্য পৃথিবীর শীর্ষ ধনী বৃদ্ধির দেশের কে বুঝবেন ঠিকা বুয়ার বাড়তি কয়েক হাজার টাকা জোগানোর যন্ত্রণা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আগেই পণ্য হয়েছে, এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে তিলে তিলে দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের সামর্থ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলোতে ক্লাস হয় না। কোচিং না করলে পাস হয় না। গ্রামগঞ্জে নবম–দশম শ্রণিতে উঠলেই মেয়েদের বিয়ের হিড়িক পড়ে যায়। গ্যারেজে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী লোকটি ঘামের বেতন নিংড়ে, পর্বতপ্রমাণ খরচের বোঝা টেনে টেনে নিজের মেয়েটিকে অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে চান।
আচ্ছা, এই সর্বোচ্চ খরচের হাইওয়ের দেশে, প্রায় লাখখানেক কোটিপতির দেশে আর এশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ ঋণখেলাপির দেশে একটি মেয়েকে মাত্র দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে ঠিক কত হাজার বাবাকে লজ্জিত হয়ে হাত পাততে হয়?
আমাদের উন্নয়নের বুদ্ধিজীবীরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বুঝে ফেলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে হাজার হাজার প্রোগ্রামার তৈরির স্বপ্নও দেখে ফেলেছেন, অথচ আমাদের শহর ও গ্রামের খেটে খাওয়া বাবা ও মায়েরা সন্তানকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে গিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছেন। তা–ও তো শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
কর্ণফুলীর নিচে দীর্ঘ টানেল হচ্ছে, ফাইভজি ইন্টারনেট নাকি গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে (! ), রাশিয়া থেকে শত শত প্রকৌশলী ভাড়া করে এনে বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ খরচে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। অথচ ১২ বছর পার হতে না হতেই আমাদের বাচ্চা ছেলেরা কাজে লেগে যাচ্ছে, ১৪ বছর পার হতে হতেই শতকরা ২০ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, আর ১৬ বছর পার হতে না হতেই বাচ্চাগুলো বাচ্চার মা হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য পড়ালেখার বিভীষিকাময় বাড়তি খরচ আর পড়তি মানে আমাদের কিছুই যায় আসে না। যে যা–ই বলুক, ভারত থেকে এসব সূচকে এগোনো আমরা! কত বড় গর্বের ব্যাপার!
এক গাড়িচালকের ছেলে জিপিএ–৫ পেয়েছে। ছেলেকে এরপর কোথায় পড়াবেন, সীমিত উপার্জন দিয়ে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারবেন কি না, এই দুশ্চিন্তায় তিনি অস্থির। বললেন, ‘ছেলে খারাপ ফল করলে কোথাও কাজে লাগিয়ে দিতাম। ছেলে পেয়েছে জিপিএ–৫, এখন কলেজে পড়াইতে লাগব, তারপর ভার্সিটিতে পড়াইতে লাগব, এত খরচ কেমনে সামলাব?’
চারদিকে টেনশন আর আতঙ্ক। লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো ‘মানুষ’ হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার আতঙ্ক।
পাঁচ বছর আগে আমার ভবন ছেড়ে চলে যাওয়া সিঁড়ি মোছার বুয়া অসহায়ের মতো ফোন দেন, ‘চিনতে পারছেন, আমি পেয়ারা, আমারে তিন হাজার টাকা ধার দেন, ছেলেটারে ভর্তি করাব, নতুন বই কিনতে লাগবে, একটু সাহায্য করেন।’ বুঝতে পারি, হ্যাপি নিউ ইয়ার জিনিসটা এই দেশে পড়ালেখা শিখে বাচ্চাকে ‘মানুষের মতো মানুষ’ করতে চাওয়া বাবা–মায়েদের জন্য এক অদ্ভুত অভিশাপ।
মাহা মির্জা উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক