৩০ জুন শুক্রবার পড়ন্ত বিকেল। একজন শিক্ষার্থীর ফোন। জানাল, সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী জড় হয়েছে। কারণ, প্রাধ্যক্ষ মহোদয় আজ বিকেলে তাদের বৈধ সিটে তুলে দিতে চেয়েছেন। আমি যদিও হলের কেউ না, প্রশাসনেরও কেউ না, কিন্তু আমি তো একজন শিক্ষক, একজন অভিভাবক—আমার সন্তানদের এই আনন্দের মুহূর্তে তাদের পাশে যাওয়া উচিত, হল প্রশাসনকে একটি ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। একা যেতে চাইছিলাম না।
এই হল-বাণিজ্য ও নৈরাজ্যের বিষয়ে সবচেয়ে সোচ্চার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকিব স্যারকে জানালাম, কিন্তু তিনি রাজশাহীর বাইরে থাকায় একাই দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হলের পথে পা বাড়ালাম।
হলের প্রবেশপথের দুই ধারে বালিশ, কাঁথা, ফ্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেন একদল শরণার্থী দীর্ঘদিন পর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তার আপন আবাসভূমে প্রবেশের অপেক্ষায়। দেখে বুকটা আনন্দে ভরে গেল। তাদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কুশলাদি বিনিময় করে আরও একটু এগিয়ে হলের ভেতরে প্রাধ্যক্ষ মহোদয়ের দপ্তরে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলে দেখি অতিথি কক্ষে তিল ধারণের জায়গা নেই। শিক্ষার্থী–সাংবাদিক সবাই ঠ্যাসাঠেসি করে বসে আছেন। অতিথি কক্ষের ভেতরেও কোনায় কোনায় বালিশ-বিছানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এগুলো সবই এ হলের বৈধ শিক্ষার্থীদের, যারা আজ হলে উঠবে বলে মেস ছেড়ে এসেছে। উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, যেসব শিক্ষার্থী অবৈধভাবে হলে আছে, তারা কেউ হল প্রাধ্যক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক হল ছেড়ে যায়নি, এমনকি তারা যে যার কক্ষে তালা দিয়ে বাইরে চলে গেছে। দেখলাম, সাংবাদিকদের মধ্যে ইতিমধ্যে সংশয় দানা বেঁধেছে, আদৌ হল প্রশাসন বৈধ শিক্ষার্থীদের তুলে দিতে পারবে কি না। তারা দুই ঘণ্টার বেশি সেখানে অবস্থান করছে। জানতে পারলাম, হল প্রশাসন প্রাধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতির জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি এলে তারা তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
প্রায় দেড় ঘণ্টা বসে থাকার পর আরও একজন শিক্ষক আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতি-খারুল আলম মাসুদ এলেন। যা হোক, একটু অস্বস্তি কাটল, মনে হলো আমি একেবারে একা নই। অবশেষে বিকেল গড়িয়ে বাইরে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে, আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। জরুরি কাজ থাকায় কিছুটা নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম। হলের গেটের মুখে তখন শিক্ষার্থীরা বসে প্রতিবাদ জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানে বলতে শুনলাম, একজন ড. জাহাঙ্গীর হেরে গেলে বাংলাদেশ হেরে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথা নিচু হয়ে যাবে। আমরা শিক্ষকেরা জাতির কাছে ছোট হয়ে যাব।
সমস্যা অনেক গভীরে, ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে পুরো শরীরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তা হচ্ছে একটি পচা–নোংরা নর্দমায় একটি ঢিল ছুড়ে নর্দমার পানি যে দুর্গন্ধযুক্ত, অন্তত সেটুকু জাতিকে জানানো গেছে। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়লে তখন হয়তো এর একটি যৌক্তিক সমাধান আসতে পারে।
গভীর রাতে জানতে পারলাম, হল প্রশাসন কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের কক্ষে তুলে দিতে সমর্থ হয়েছে। জানালা দিয়ে দেখলাম বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছে। গভীর রাতের এই স্বস্তির বৃষ্টি বিকেলের বিষণ্নতা মন থেকে ধুয়ে দিল। আমাদের স্বস্তি, একজন প্রাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর হেরে যাননি। তিনি পেরেছেন। কিন্তু সকাল পেরিয়ে দুপুর না গড়াতেই জানতে পারলাম, ঘোষিত অবৈধ শিক্ষার্থীদের কাউকেই হল থেকে নামানো যায়নি। শুধু যারা বৈধ শিক্ষার্থী, যারা অনেক দিন থেকে হলে না থেকেও
হলের মাসিক ভাড়া দিয়ে আসছে, তাদের কয়েকজনকে একটি কক্ষ যেখানে পুলিশ সদস্যরা অবসর নেন, এমন একটি কক্ষে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিংবা কাউকে
অন্যের সঙ্গে ডাবলিং করে তুলে দেওয়া হয়েছে। খুব ব্যথিত হলাম এই ভেবে যে প্রাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর পেরেছেন আবার পারেননি। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে ভুলে গেছে, সেখানে একজন প্রাধ্যক্ষের কতটুকুই–বা দাঁড়িয়ে থাকার নৈতিক শক্তি আছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নৈরাজ্য চলছে, সেটি কোনো স্থানীয় সমস্যা নয় বরং একটি জাতীয় সমস্যা। ফলে স্থানীয়ভাবে এর সমাধান কঠিন। পত্রিকায় এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়সহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদের অনেকে স্বীকার করেছেন—এখানে নৈরাজ্য চলছে। একটি স্থানীয় পত্রিকা জানাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন, বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায়। এতে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কতটা অসহায়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং হতাশার। বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান—৭৩–এর অধ্যাদেশ বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সেটি তারা করছে না বা করতে পারছে না।
আশার কথা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শিক্ষক-ছাত্রের সম্প্রতি চলমান প্রতিবাদের ফলে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্রও উঠে আসতে শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে অনুসন্ধানমূলক খবর প্রথম আলো ছেপেছে।
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই নৈরাজ্য শক্ত এবং ভীতিকর ভিত গড়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সচেতন এবং বিবেকবান শিক্ষকের মধ্যে এই জাগরণ ছড়িয়ে পড়তে হবে যে আমরা হারতে পারি না। আমাদের কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না।
তবে এটাও সত্য, সমস্যা অনেক গভীরে, ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে পুরো শরীরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তা হচ্ছে একটি পচা–নোংরা নর্দমায় একটি ঢিল ছুড়ে নর্দমার পানি যে দুর্গন্ধযুক্ত, অন্তত সেটুকু জাতিকে জানানো গেছে। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়লে তখন হয়তো এর একটি যৌক্তিক সমাধান আসতে পারে।
আমাদের সান্ত্বনা, আমরা প্রতিবাদ করছি, পাছে কেউ না বলে আমরা প্রতিবাদ ভুলে গেছি। আমরা ভয় পেয়ে উটপাখির মতো মাথা গুঁজে থাকিনি।
কিন্তু এই অসুখের স্থায়ী চিকিৎসার দিকেই আমাদের যেতে হবে। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে চলতে পারে না। শিক্ষক সমাজ, অভিভাবক, সচেতন নাগরিক সমাজকে এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই হবে।
সভ্যতার উল্টো পথে আমরা যেভাবে হাঁটছি, এভাবে চলতে থাকলে যতই উন্নয়ন হোক, তার সুফল জাতি ঘরে তুলতে পারবে না। প্রাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আমাদের পথ দেখিয়েছেন। আরও জাহাঙ্গীর এভাবে এগিয়ে আসুক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, জুলুমের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হই, জেগে উঠি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নৈরাজ্যমুক্ত করতে হবে আমাদেরই।
ড. ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক