বাংলাদেশের শিল্পজগতে মুক্তিযোদ্ধা, স্রষ্টা ও শিল্প-উদ্যোক্তা, বহু গুণে গুণান্বিত ও শিল্পী নিতুন কুন্ডু একজন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এ রকম কাজপাগল, শ্রমনিষ্ঠ, প্রতিভাবান শিল্পী দেখা যায় না সচরাচর। নিজের প্রবল একাগ্রতা, লক্ষ্যভেদী দূরদৃষ্টি ও অনুপম সৃষ্টিশীলতা নিয়ে তাঁর কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বলা যায়, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি বিশাল মহিরুহে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন। মূলত তিনি একজন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ছিলেন। পাশাপাশি ভাস্কর্যে তাঁর ঈর্ষণীয় ক্ষমতা কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। আজীবন জেদি, সংগ্রামী ও লড়াকু জীবন কাটিয়েছেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান ও মরমি শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদের প্রিয় ছাত্র ছিলেন এবং ছিলেন সব সময় সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী। এ দেশের শিল্পজগতে শিল্পী নিতুন কুন্ডুর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল এমন যে তিনি শিল্পকর্মকে শিল্পীর ক্যানভাস থেকে তুলে নিয়ে ফলিত বা ব্যবহারিক গুণে উদ্ভাসিত করতে পেরেছিলেন। ‘রংতুলি, রেখা, বুনন শুধু চিত্রপটেই রইবে’—এই ধারণাকে শিল্পী টেনে নিয়ে চারদিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অনুষঙ্গের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
‘সৌন্দর্য বা নান্দনিক বোধ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু ক্যানভাসেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইবে না’—এই সৌন্দর্যানুভূতির চর্চা করার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করেছেন খুব সফলভাবে। ‘সুন্দর করে বেঁচে থাকার অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে ঘরের সৌন্দর্য রক্ষা করা আর বৃদ্ধি করা দরকার’—এই মূল বিষয়টির প্রয়োজনীয় উপাদান কী, এর উত্তরে ঘরের আসবাবকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে তিনি আসবাব, যেমন চেয়ার, টেবিল, সোফা, খাট, আলমারি—প্রতিটা জিনিসকে শিল্পমণ্ডিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেগুলো নান্দনিক দিক থেকে যেমন সুন্দর হবে, সঙ্গে সঙ্গে হবে ব্যবহারোপযোগী ও টেকসই। এসব নকশা ও তার বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি ‘অটবি’ নামে বিশাল শিল্পরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এবং অটবির সামগ্রী এখন ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারে বিস্তৃত হয়েছে—বিষয়টি খুব গর্ব ও অহংকারের।
একজন শিল্পীর পক্ষে বিষয়টিই খুব চমকপ্রদ ও ব্যতিক্রমী। শিল্পী নিতুন কুন্ডুর চিত্রকর্ম, যা আমরা দেখেছি, তাতে প্রমাণিত হয়, তিনি যেমন উঁচু দরের বাস্তবধর্মী শিল্পী, তেমনি বিমূর্ত প্রকাশবাদীও। ছবির মধ্যে তাঁর পেলব রং ব্যবহার, স্নিগ্ধ, শীতল ও রোমান্টিক আবহ নির্মাণের শিল্পকুশলতা, জ্যামিতিক গঠনের প্রতি একধরনের কৌণিক ত্রিভুজাকৃতির শিল্পসুষমা দ্বারা দৃঢ়-কঠিন অথচ নরম অনুভূতির সারাৎসার খুঁজে পাওয়া যেত। একজন শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি, অন্তর্মুখী খুঁটিনাটি দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা—এ সবই তাঁকে যন্ত্রশিল্পের মধ্যে যে আপাতকাঠিন্য বিরাজ করে তার মধ্য থেকে সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে। সার্ক ফোয়ারা, কদমফুল ফোয়ারা ইত্যাদির মধ্যে সেই নান্দনিকতা, যাকে বলা যায় যন্ত্রসৌন্দর্য, খুঁজে পাওয়া যায়।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর দুটি পোস্টার—একটি এক টগবগে যুবকের রাইফেল কাঁধে দৃঢ়-কঠিন মুখাবয়ব দেশের স্বাধীনতার জন্য, আরেকটি একজন স্নেহশীলা অকুতোভয় মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি—স্থায়ী হয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রকর্মে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাবাশ বাংলাদেশ’ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যশিল্পের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পনিদর্শন, যেখানে সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে অনুপম সৃষ্টি দেখা যায়। অস্থির গতিচাঞ্চল্য এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি মুক্তিযোদ্ধার দৃঢ় অঙ্গীকার ও লক্ষ্য খুব বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। লাল বেলেপাথরের মতো ভাস্কর্যের রং, মুক্তিযোদ্ধা দামাল ছেলেদের গাত্রবর্ণ, সামনের দিকে দৃষ্টি, অকুতোভয় মনোবল—সব প্রকাশ পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে শত্রুর প্রতি জান বাজি রেখে সংগ্রামের ইস্পাতকঠিন প্রত্যয়ও এভাবে তিনি তাঁর শৈল্পিক অনুপম সৃষ্টিশীলতা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পূর্ব আমলের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাঁর দ্বারা মঞ্চ, পোস্টার, রাস্তার মোড়ে ব্যানার বা শিল্পকর্ম ছাড়া সেগুলো কখনো পূর্ণতা পেত না।
শিল্পী নিতুন কুন্ডু তাঁর সৃষ্টিকর্ম দ্বারা বলা যায় আমাদের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোকে শিল্পসুষমায় পর্যবসিত করার জন্য বিরাট অবদান এবং এ বিষয়ে সত্যিকারের অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর এই চলে যাওয়া খুবই আকস্মিক। হৃদ্রোগী ছিলেন বহুদিন, সার্ক ফোয়ারা নির্মাণের সময় তাঁর প্রথম আক্রমণ হয়। অমানুষিকভাবে দিনের পর দিন পরিশ্রম করতে পারতেন। দিনাজপুর শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একজন যুবক সারাটি জীবন সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে জীবনকে যেমন পরাস্ত করতে পেরেছিলেন জীবনযুদ্ধে, তেমনি তিনি শিল্পজগতের দুটো দিক—একটি বাণিজ্য শিল্প আর একটি চারু, কারু ও ভাস্কর্যশিল্পকে অসামান্য আপন প্রতিভাবলে শাসন করার দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি তাঁর একজন স্নেহধন্য পারিবারিক স্বজন হিসেবে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ ও সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। তাঁর এই অসময়ের তিরোধান খুবই আকস্মিক ও অভাবনীয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশ, সমাজ, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক জগতে যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর সুন্দর ব্যবহার, প্রাণচাঞ্চল্য ভরা হাসি, পরোপকারী হৃদয়বেত্তা, সর্বোপরি উদার প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা ও দেশপ্রেম সব সময় আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। তাঁর পরম ভালোবাসা ও যাবতীয় কর্মোদ্যোগের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের উৎস জীবনসাথি প্রিয়তমা ফালগুণী বউদি, প্রিয়তম অনিমেষ বাবু আর বুকের ধন অমিতি মামণি এবং অটবির অসংখ্য উদ্যমী কর্মী-সহযোগী তাঁর অনুপস্থিতিতে যেন সামনের ভবিষ্যৎ যাত্রার পথ ধরে সুন্দর করে এগিয়ে যেতে পারেন, সেই সার্থকতাই সবার প্রিয় নিতুনদাকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে।
আজ এই ১১তম মহাপ্রয়াণবার্ষিকীর দিনে তাঁকে হৃদয় ও মনের ভেতরে নিয়ে পরম শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে সবার সঙ্গে নিবিড়ভাবে স্মরণ করি।
রবিউল হুসাইন: কবি ও স্থপতি।