তৃতীয় শ্রেণির এক শিশু তার ফেসবুক পাতায় লিখেছে, ‘এত দিন তো বোর হলাম। যাক সেপ্টেম্বর ১২–তে স্কুল খুলবে। এখন আর বোর হব না। এখন স্কুলে যেতে পারব—অনেক মজা, চিল!’ আমার বিশ্বাস, এই পোস্টে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বর্তমান মনের অবস্থা দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে খুশির সংবাদ হলো স্কুল খুলছে। শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রেণিকক্ষে ফিরবে। আবার স্কুলে স্কুলে বসবে প্রাণের মেলা। কচিকাঁচার কলকাকলিতে ভরে উঠবে শিক্ষাঙ্গন। বিষণ্নতা আর হতাশার দিন শেষ হবে। প্রাণ ফিরে পাবে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। এই উচ্ছ্বাসের মধ্যেও উদ্বেগের কালো ছায়াও অনেক অভিভাবককে আচ্ছন্ন করছে—তাদের প্রিয় সন্তান নিরাপদে স্কুল করতে পারবে তো?
ঘরে বসে থেকে শিশুরা হাঁপিয়ে উঠেছে। স্কুল বন্ধ থাকায় লাখ লাখ শিক্ষার্থীর লেখাপড়া ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে রাখার পরিণতি মারাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী। ফলে তাদের মতে স্কুল খোলা নিয়ে আর প্রতীক্ষা নয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এই অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতা ও উপার্জন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে, যা ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনকে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং করে তুলবে। এই বাস্তবতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজাগুলো খোলার সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োপযোগী। তবে স্কুল খোলার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে মূল যে চ্যালেঞ্জটি সামনে এসেছে, তা হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদে স্কুল খোলা।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, বিশ্বজুড়ে যেসব দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলা হয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, পর্যাপ্ত সংক্রমণ প্রশমনকৌশল গ্রহণ করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী–শিক্ষক ও কমিউনিটির মধ্যে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি কম। যুক্তরাষ্ট্রের তুলান বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত ‘কোভিড-১৯ হাসপাতালে ভর্তির হারের ওপর স্কুল খোলার প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা যায় সরাসরি পাঠে আর দূরবর্তী পাঠের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ হাসপাতালে ভর্তির হারের ওপর স্কুল খোলার কোনো প্রভাব নেই। একইভাবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একটি গবেষণা অনুযায়ী, স্কুল বন্ধ রাখা এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণ হারের হ্রাসের মধ্যে সামান্য সম্পর্ক পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইতালিতে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, যদিও স্কুলে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে, তবে স্কুলের কাঠামোর মধ্যে সংক্রমণ সাধারণত কমিউনিটি সংক্রমণের হারের চেয়ে কম বা একই, বিশেষ করে যখন স্কুলে প্রতিরোধের কৌশলগুলো মেনে চলা হয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশে যেখানে স্কুলের বাইরে স্বাস্থ্যবিধি মানায় দিন দিন ভাটা পড়ছে, সেখানে স্কুল খুলে পশ্চিমা দেশগুলোর আদলে কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করা সম্ভব হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, নিরাপদে স্কুলগুলো পুনরায় চালু করতে ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুটি প্রতিরোধকৌশলে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত—মাস্কের সর্বজনীন ও সঠিক ব্যবহার এবং শারীরিক দূরত্ব যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ করা। এ দুটি অন্যতম এবং অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আরও কিছু প্রয়োজনীয় নিয়ম মেনে চলা আবশ্যক।
অনেক শিক্ষার্থী, বিশেষ করে যারা দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে, এদের অনেকে কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের পক্ষে আবার শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসা কষ্টকর হবে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরতে না–ও পারে। যারা নিয়মিত ক্লাসে আসছে না, তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে
যেমন ১. স্কুলে টিফিন বা দুপুরের খাবারসহ কোনো প্রকার খাদ্য গ্রহণ না করা। স্কুলের বাইরেও স্ট্রিট ফুড বিক্রি বন্ধ করা। কেননা, মাস্ক খুলে খাবার গ্রহণের সময় সংক্রমণঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। ২. স্কুলে আপাতত অ্যাসেম্বলি এবং কোনো প্রকার অন্তঃকক্ষ খেলাধুলা কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন না করা। পাশাপাশি করমর্দন, মোলাকাত প্রভৃতি এবং ক্লাসের ফাঁকে অপ্রয়োজনে চলাফেরা নিরুৎসাহিত করা। ৩. প্রতি বেঞ্চে পরীক্ষার হলের মতো রোল নম্বর অনুযায়ী একটি আসন ফাঁকা রেখে আসন নির্দিষ্ট করে দেওয়া, যাতে একে অন্যের মধ্যে দূরত্ব বজায় থাকে, আসন ধরা নিয়ে তাড়াহুড়ো না থাকে এবং কেউ অসুস্থ হলে দ্রুত তার পাশের জনদের ট্রেস করা যায়। ৪. আপাতত সপ্তাহে তিন দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বেলা ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দুটি শিফট চালু করা যেতে পারে, যেখানে অপেক্ষাকৃত নিচের ক্লাসগুলো সকালে আর ওপরের ক্লাসগুলো বিকেলের শিফটে থাকবে। ৫. শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত আলো–বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা এবং বেঞ্চগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা সবাই একমুখী হয়ে বসতে পারে। ৬. স্কুলে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৭. পুষ্টিকর ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের বিষয়ে এবং হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশি কিংবা থুতু ফেলার শিষ্টাচারগুলো মেনে চলার বিষয়ে শিশুদের সচেতন ও উৎসাহিত করা। ৮. শ্রেণিকক্ষে প্রবেশের আগে সবার তাপমাত্রা পরীক্ষা করা। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিজেদের কিংবা পরিবারের কোনো সদস্যের করোনার উপসর্গ দেখা দিলে তাদের স্কুলে না আসার নির্দেশনা দেওয়া। অভিভাবকদের কাছেও অনুরোধ করা যেন এমন পরিস্থিতি দেখা দিলে সন্তানকে স্কুলে না পাঠান।
এসব স্বাস্থ্যবিধির পরিপালন নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। কঠোর তদারকি করতে হবে। দুঃখজনকভাবে লক্ষ করা যায়, বিধিনিষেধ শেষ হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি আগ্রহ কমে যায়, মাস্ক পরিধান করার প্রতি একধরনের অনীহা তৈরি হয়। জনসমাগম এড়িয়ে চলার চেষ্টায় ভাটা পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি এই শৈথিল্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোটেও সমীচীন হবে না।
সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কিছু সামাজিক দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিং ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা হতাশা থেকে নেশার জগতে পা বাড়িয়েছে, যাদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এবং যারা অনলাইনে অতিরিক্ত সময় স্ক্রিনে থেকে স্ক্রিন–আসক্তিতে ভুগছে, তাদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত, অনেক শিক্ষার্থী, বিশেষ করে যারা দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে, এদের অনেকে কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের পক্ষে আবার শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসা কষ্টকর হবে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরতে না–ও পারে। যারা নিয়মিত ক্লাসে আসছে না, তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ওই সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই যেন পড়ালেখা নিয়ে চাপ বোধ না করে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ইদানীং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা পরীক্ষানির্ভর হয়ে পড়ছে। শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর দিন দিন পরীক্ষাকেন্দ্রে রূপান্তর ঘটছে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে শিক্ষকের বাসার ছাত্র পড়ার ঘরে কিংবা কোচিং সেন্টারে। বিশেষ করে করোনা অতিমারির এই সংক্রমণকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষা নয়, বরং শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পড়ালেখার চাপে শিক্ষার্থীদের যে সামাজিক দক্ষতা ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়, সেসব বিবেচনায় এনে বিশ্বের অনেক দেশ শিশু-কিশোরদের পরীক্ষার চাপ এবং বইয়ের ব্যাগের বোঝা—দুটোই কমিয়েছে।
ভয় নয়, সচেতনতাই হোক আমাদের আগামী দিনের স্কুল খোলার মূল শক্তি। স্কুল আমাদের ঝিমিয়ে পড়া বিপর্যস্ত প্রজন্মকে আবার জাগিয়ে তুলুক নিও নরমাল বাংলাদেশে। কেননা, আজকের শিশুই আমাদের ভবিষ্যৎ। একটি সচেতন শিশু মানে একটি সচেতন পরিবার। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। সঠিক সচেতনতা ও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি এবং কৌশল মেনে স্কুলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিরাপদে স্কুল খোলাটা শিশুদের জন্য ও জাতির জন্য বেশি মঙ্গলজনক এবং সেটিকেই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন, সঠিক মাস্ক ব্যবহার ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিভাবক ও শিশুদের সঙ্গে নিয়মিত ও যথাযথ যোগাযোগ বজায় রাখা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সবার আন্তরিকতা, সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে স্কুলকে নিরাপদ রাখতে।
ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
faridecoru@yahoo. co. uk