২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সাহ্‌রির তাৎপর্য ও বিধান

সাহ্‌রি রোজা ও রমজানের অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম অনুষঙ্গ। সাহ্‌রি শব্দের অর্থ শেষরাতের খাবার। ইসলামি পরিভাষায় রোজা বা সওম পালনের উদ্দেশ্যে ভোররাতে সুবহে সাদিকের আগে যে আহার গ্রহণ করা হয়, তা–ই সাহ্‌রি। সাহ্‌রি একটি বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ সুন্নত। তাকওয়া অর্জন এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য সাহ্‌রির গুরুত্ব অপরিসীম। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা সাহ্‌রি খাও, কেননা সাহ্‌রিতে রয়েছে বরকত।’ (বুখারি, হাদিস: ১৮০১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘আমাদের রোজা আর আহলে কিতাবদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহ্‌রি খাওয়া আর না খাওয়া।’ (মুসলিম, আলফিয়াতুল হাদিস, পৃষ্ঠা: ১৩১)।

‘সাহ্‌রির সময় শুরু হয় অর্ধরাত্রির পর থেকে।’ (মোল্লা আলী কারি, মিরকাত শরহে মিশকাত)। ইমাম যামাখ্শারি (রা.) ও ফকিহ আবুল লাঈস ছমরকন্দী (রহ.)–এর মতে সাহ্‌রির সময় হলো রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশ। সাহ্‌রি বিলম্বে খাওয়া সুন্নত। তবে সন্দেহের সময় পর্যন্ত বিলম্ব করা যাবে না, তার পূর্বেই সাহ্‌রির নিরাপদ সময়সীমার মধ্যে পানাহার শেষ করতে হবে। রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাহ্‌রি খাও; যদি তা এক ঢোঁক পানিও হয়।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমরা সাহ্‌রি খাও; যদি এক লুকমা খাদ্যও হয়।’ (মুসলিম)। অর্থাৎ যেকোনো প্রকার ও যেকোনো পরিমাণ খাদ্য বা পানীয় দ্বারাই সাহ্‌রির সুন্নত পালন হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে সাহ্‌রি না করলে সুন্নত তরক হবে।

সাহ্‌রির সময় জাগ্রত হওয়া রোজার প্রতি আগ্রহের প্রকাশ। সাহ্‌রির সময় প্রশান্তির নিদ্রা পরিহার করে শয্যা ত্যাগ করা ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতি অনুরাগ। এতে শেষ রাতে জাগ্রত হওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে এবং তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের সুযোগ হয়। সাহ্‌রির সময় জাগ্রত হওয়া একপ্রকারের মুজাহাদা বা সাধনা। এই সময় আল্লাহর রহমত নাজিলের সময়, অগণিত আল্লাহপ্রেমীদের ফরিয়াদ ও দোয়া কবুলের সময়, আল্লাহর নৈকট্য লাভের সবচেয়ে উত্তম সময়। যঁারা এই বরকতময় সময় জাগ্রত হয়ে আল্লাহর মহান দরবারে দোয়া করে থাকেন এবং ইস্তিগফার করেন, আল্লাহ তাঁদের স্বীয় ভালোবাসার বারিধারায় সিক্ত করেন। সর্বোপরি সাহ্‌রি রোজা রাখার জন্য সহায়ক। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন, ‘তারা (মুমিনগণ) রাত্রির শেষ অংশে আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে থাকে।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৮)।

বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে বরকতময় সাহ্‌রির মধ্যে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সুন্নতের অনুসরণ করা, ইসলামের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা, ইবাদতের জন্য শক্তি সঞ্চয় করা এবং তাকওয়া অর্জন করা। স্বাস্থ্য ও মনের অধিক প্রফুল্লতা লাভ করা, ক্ষুধার তাড়নায় সৃষ্ট প্রবৃত্তির বাসনা নিরাময় করা। সাহ্‌রির সময় দোয়া কবুল হয়। সাহ্‌রির সময় অধিক পরিমাণে জিকির আসকার করা এবং তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া মোনাজাত করা উত্তম।

সওম বা রোজা হলো পানাহার ও রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকা। তাই সাহ্‌রিতে এত বেশি খাওয়া ঠিক হবে না, যা সিয়াম বা রোজার উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। মনে রাখতে হবে, রমজান যেন ভোজের আয়োজনে পরিণত না হয়। সাহ্‌রিতে স্বাস্থ্যসম্মত আহার গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়, অধিক পরিমাণে তরল ও পানীয় গ্রহণ করা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শমতো প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য গ্রহণ করতে হবে। দেহ ও মন ভালো থাকলে ইবাদত আনন্দঘন হবে।

যদি কখনো এমন হয় যে ফরজ গোসল করে সাহ্‌রি খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় না থাকে; তখন অজু করে বা হাত–মুখ ধুয়ে আগে সাহ্‌রি খেয়ে নিতে হবে। তারপর গোসল করে ফজরের নামাজ আদায় করতে হবে। কারণ সাহ্‌রি খাওয়ার জন্য পবিত্রতা ফরজ নয় বরং সুন্নত; আর নামাজ আদায় করার জন্য পবিত্রতা ফরজ। গোসল ফরজ হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোসল করে নিতে হবে, বিনা ওজরে বেশি সময় অপবিত্র অবস্থায় থাকা সমীচীন নয়; আর রমজানে রোজা অবস্থায় অধিকক্ষণ অপবিত্র থাকা মোটেও উচিত নয়, এটি মকরুহ। সাহ্‌রি খাওয়া সম্ভব না হলেও রমজানের ফরজ রোজা রাখতে হবে।

নিজেরা সাহ্‌রি খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, অভাবী অসহায় মানুষদের সাহ্‌রিতে সহযোগিতা করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পেট পুরে পানাহার করে পরিতৃপ্ত হলো, তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটাল, সে মুমিন নয়।’ (তিরমিজি)। সাহ্‌রি একটি ইবাদত, এই ইবাদতকে কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা এমন কোনো রসুম রেওয়াজ বা প্রথায় পরিণত করা যাবে না, যাতে এর ধর্মীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এবং শরিয়তের বিধান লঙ্ঘিত হয় অথবা কোনো গুনাহের কারণ হয়। তাই সাহ্‌রি পার্টির মতো ভুল প্রথা চালু করা গ্রহণযোগ্য নয়। এতে রাতের নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের বিঘ্ন সৃষ্টি হবে এবং নানা জটিলতা তৈরি হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]