আরেকজন সাংবাদিক নিহত হলেন ‘মহান একুশে’র চেতনা উদ্যাপন দিবসের দুই দিন আগে—১৯ ফেব্রুয়ারিতে। ওরা আমাদের ‘মুখের ভাষা কাইড়া নিতে’ চেয়েছিল, এরা সাংবাদিকের জীবনটাই কেড়ে নিচ্ছে। সাংবাদিকতা নাকি মহৎ পেশা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ২৩ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন; আহত হয়েছেন ৫৬১ জন (প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি)। আরেকটি হিসাবে বলা হচ্ছে, ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। নোয়াখালীর সাংবাদিক বুরহান মুজাক্কিরকে হত্যার ঘটনা নিহতদের তালিকায় যোগ হওয়া আরেকটি নতুন সংখ্যা মাত্র।
এত সাংবাদিক নিহত হলেন, অথচ বিচার শেষ হয়েছে মাত্র আটটির। এই আটটির বিচারিক রায়ের পাঁচটিই ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে জানিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস। তাহলে বিচার হলো কার? বিচার না পাওয়া ব্যক্তিদের দলে রয়েছে সাংবাদিক সাগর-রুনির সন্তান মেঘ। রক্ত হিম করা এই যুগল হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার তারিখ ৯ বছরে ৭৭ বারের মতো পেছাল।
বুরহান হত্যা মামলার বিচারও কি রহস্যের চোরাগলিতে হারাবে? আওয়ামী লীগের দুই জাঁদরেল নেতার অনুসারীদের গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে নিহত হয়েছেন তিনি। সংঘর্ষকারীদের ছোড়া গুলি তাঁর গলা, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্ধ হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পুলিশি বয়ান ‘ক্রসফায়ারের’ গল্পের আদলেই বর্ণিত হচ্ছে। পুলিশ অজ্ঞাতনামা ৫০০-৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলেও কার গুলিতে এই তরুণ সাংবাদিক ঝাঁজরা হলেন, সেদিকে নজর কম। দুই পক্ষের মাঝখানে পড়ে গিয়ে ‘অনিচ্ছাকৃত’ আঘাতে মৃত্যুকেই বলে ক্রসফায়ার। একসঙ্গে এতগুলো গুলি দুর্ঘটনাক্রমে বা অনিচ্ছাবশত কারও শরীরে বিদ্ধ হতে পারে কি? প্রত্যক্ষদর্শী মোজ্জামেলের বয়ান অন্য রকম, ‘ওই সময় ছবি তুলছিল সাংবাদিক মুজাক্কির (বুরহান)। এ সময় হঠাৎ করে “আমাকে বাঁচান” বলে মাটিতে পড়ে যায় মুজাক্কির। পরে আমিসহ আরও লোকজন এসে তাকে হাসপাতালে পাঠাই।’ প্রশ্নটা সহজ কিন্তু উত্তরটা বড়ই জটিল এই বাংলাদেশে। তাহলেও বুরহান মুজাক্কিরের মোবাইলে তোলা ছবি ও ভিডিও কিছু জানাতে পারে বোধ হয়।
ওই সংঘর্ষে জড়িত ছিল তিনটি পক্ষ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই বসুরহাটের পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জার অনুসারীরা গুলি ছুড়েছেন, গুলি ছুড়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীরা এবং সংঘর্ষ থামাতে গুলি ছুড়েছে পুলিশ। দায় এঁদের কাউকেই নিতে হবে। নইলে ঘটনা দাঁড়াবে সাগর-রুনির মতো, কুমিল্লার তনুর মতো।
সাংবাদিকতা মানে জান ও জবানের স্বাধীনতা। নিরাপদ ও আইনি মৃত্যুর নিশ্চয়তা না থাকলে, কথা বলার স্বাধীনতা না থাকলে সাংবাদিকতা হয়ে দাঁড়ায় পানি ছাড়া মাছের মতো। এ অবস্থায় জানে বাঁচতে পারাই পরম সৌভাগ্য। এই সৌভাগ্য ঢাকার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের হয়েছে, ৫৪ দিন নিখোঁজ এবং পৌনে দুই মাস জেল-রিমান্ড প্রভৃতি ভোগের পর তিনি মুক্ত হয়েছেন। সাংসদের করা মামলা মাথায় নিয়ে ভগ্নস্বাস্থ্য, মানসিক আঘাতের সঙ্গে তিনি নিশ্চুপ থাকার শাস্তি ভোগ করছেন। চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার চার দিন নিখোঁজ থাকার পর আহত অবস্থায় ছাড়া পেয়ে স্বজনদের দেখেও ভেবেছিলেন বোধ হয় আবারও নির্যাতন শুরু হবে। আতঙ্কে বলে উঠেছিলেন, ‘আমি আর নিউজ করব না, আমাকে মারবেন না প্লিজ।’ এ মাসের শুরুতেই সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বালুদস্যুদের অপকর্ম দেখতে যাওয়ার অপরাধে স্থানীয় সাংবাদিক কামাল হোসেনকে ‘দা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে এবং তাঁর ক্যামেরা ও মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বেদম প্রহার করার পর তাঁকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল।’ এমন ঘটনা বেশুমার, এগুলো নমুনামাত্র।
কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তঁার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কারণ, সাংবাদিকেরা আইনের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে সৎ সাংবাদিকতার টুঁটি চিপে ধরা, মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার-নির্যাতন আর কিছু নয়, অসৎ মানুষদের প্রতিহিংসা। বিপুল ক্ষমতাশালী মানুষদের ক্রোধ ও আক্রমণের মুখে সবচেয়ে অসহায় মফস্বল সাংবাদিকেরা। মামলা হলে তা সামলানো কিংবা হামলা হলে বিচার চাওয়ার হুজ্জত মোকাবিলা করা সাধারণ সাংবাদিকদের পক্ষে অসম্ভব, যদি তাঁদের প্রতিষ্ঠান পাশে না দাঁড়ায়। বিভক্ত সাংবাদিক সমিতিগুলোও উদাসীনতাই শ্রেষ্ঠ পন্থা মনে করে।
রক্তের দাগ শুকিয়ে যাবে, কবরে ঘাস গজাবে, মানুষও সাংবাদিকতা পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত মানুষদের ভুলে যাবে। যদি সংবাদপত্রের কাগজগুলো সাদাই থাকত, টেলিভিশনের পর্দা দিনরাত ঝিরঝির করত আর অনলাইন পোর্টালগুলোতে লেখা থাকত ‘৪০৪ সিস্টেম এরর’—তাহলে হয়তো সাংবাদিকতার জরুরত মালুম হতো অনেকের। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনকে তখন এতটা ‘স্বাভাবিক’ মনে হতো না। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে সে উপায়ও নেই গণমাধ্যমের। একদল সাংবাদিক তবু পেশাগত পবিত্রতা মাথায় নিয়ে পবিত্র প্রাণীর মতো অপঘাতের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যান। পরাজয় জেনেও যিনি লড়াই করে যান, তাঁকেই বলে সংশপ্তক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখন সংশপ্তক পর্ব পার করছে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক