এমন দিন খুব কম যায়, যেদিন পত্রপত্রিকায় আত্মহত্যার খবর থাকে না। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে গড়ে দৈনিক ২৮ জন আত্মহত্যা করেন। বেশির ভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী। এ ছাড়া বাংলাদেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে আছেন। তাঁদের বেশির ভাগই অল্প বয়সী এবং ৮৯ শতাংশই নারী। প্রতিবছরই বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে। তবে করোনাকালে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।
পাবলিক পরীক্ষার আগে ও পরে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা এখন প্রায় আতঙ্কের পর্যায়ে চলে গেছে। সফল-অসফল সব পরীক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি দেখা যায়। অন্য ছাত্রছাত্রীদের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করে অভিভাবকদের চিরাচরিত আগ্রাসী ভর্ৎসনা অনেক শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যার মতো হঠকারী সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। যাঁদের সন্তানেরা কথিত ‘ভালো ফল’ করেন, তাঁদের অতি আদিখ্যেতামেশানো বিজ্ঞাপন, ফেসবুক স্ট্যাটাস অন্য শিক্ষার্থীর নিগ্রহের কারণ হয়ে ওঠে অনেক সময়। আনন্দে উদ্বেলিত অভিভাবকেরা সেদিকে খেয়াল করেন না। উদ্যাপনের লাগামছাড়া ‘শোডাউন’–এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তাঁরা একটু সচেতন হলে অনেক প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব।
খেয়াল রাখতে হবে ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি। খেয়াল রাখতে গিয়ে মনমরা বা বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন মানুষকে শিশু-কিশোর-তরুণদের আমরা চিকিৎসকের কাছে হাজির করি। চিকিৎসকের কাছে নেওয়াটা খারাপ কিছু নয়। তবে গত তিন–চার বছরের অনেকগুলো আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় অনেক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, এমনকি মাঝবয়সী মানুষ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন অথবা অন্য কোনোভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
গত ২৮ নভেম্বর রাজধানীতে ১৬ বছর বয়সের এক স্কুলশিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। সরকারি বিজ্ঞান স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল সে। তার বাবা বলেন, ‘করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ছেলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। আমি তাকে চিকিৎসক দেখিয়েছি, চিকিৎসা চলছিল।’ একই মাসের ৮ তারিখে ভৈরবে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে উপজেলার কমলপুর হাজী জহির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, পরীক্ষা নিয়ে তার দুশ্চিন্তা ছিল, একপর্যায়ে বিষণ্নতা ভর করে তার মনে। বিষণ্নতার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল তাকেও।
আমরা ওষুধের সঙ্গে থাকা কাগজ পড়ি না, পড়তে দুই থেকে তিন মিনিটের বেশি লাগে না। পড়ি না, কারণ, মনে করি, আমি ওসবের কী বুঝব। চিকিৎসকদের আমরা সাধারণত জিজ্ঞাসা করি না এই ওষুধ কেন দিচ্ছেন? এটা না খেলে কী হবে? খেলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে? কত দিন খাব? বিষণ্নতার চিকিৎসায় ছিলেন, এমন ব্যক্তিদের আত্মহত্যার ঘটনার পর ঘটনাগুলোর তদন্ত ও এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
বছর তিনেক আগে সিলেট নগরীর মিতালী আবাসিক এলাকায় একটি ভবনের ছাদ থেকে লাফ দেন প্রবাসজীবন থেকে ফেরত আসা এক যুবক। নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই জানান, মধ্যপ্রাচ্য থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে তিনি দেশে আসেন। এর পর থেকে চিকিৎসা চালিয়ে আসছিলেন তাঁরা। সকালে পরিবারের অজান্তে জিল্লুর বাড়ির ছাদে উঠে নিচে পড়ে মারা যান।
গত ১৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের পাঁচ তারকা হোটেল র্যাডিসন ব্লু চট্টগ্রাম বে ভিউর ২০ তলা থেকে লাফ দেওয়া কিশোরটি প্রাণে বাঁচেনি। লাফ দেওয়ার আগে নাশতার অর্ডার দিয়েছিল সে। ধীরে ধীরে নাশতা করে। উপস্থিত দুজন বিদেশির সঙ্গে কথাও বলে। ঢাকার উত্তরায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া কিশোরটিকে সবার কাছে সাবলীল আর স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল। কেউ ধারণা করতে পারেনি কিশোর ছেলেটি কিছুক্ষণের মধ্যে লাশ হয়ে যাবে। পরে জানা যায়, পিতৃহারা ছেলেটি কিশোর বয়স থেকেই বিষণ্নতায় ভুগছিল। মানসিক রোগের চিকিৎসা দেন, এমন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে নিয়মিত ওষুধ নিতে হতো।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পরীবাগে দুই ভবনের মাঝখান থেকে পুলিশ উদ্ধার করে উত্তরার স্কলাসটিকা স্কুলের এক কর্মকর্তার লাশ। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ বলছে, ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন এই নারী। মৃতের শ্বশুরবাড়ির লোকজন দাবি করছেন, তিনি অসুস্থ ছিলেন। কেমন অসুস্থ ছিলেন? কার চিকিৎসায় ছিলেন? পত্রপত্রিকায় ছাপা হয় মানসিক অসুস্থতার খবর। স্বামীর বন্ধু চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের খবর। লাশ দাফনের সঙ্গে সঙ্গে সেসব আলোচনাও হারিয়ে যায়। শুধু থেকে যায় তাঁর শিক্ষক আইনজীবী রুমিন ফারহানার মর্মস্পর্শী মতামত কলাম (২২ সেপ্টেম্বর ২০২১, প্রথম আলো)।
২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর লালমাটিয়া মহিলা কলেজের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন অনার্সের এক ছাত্রী। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাঁর মানসিক সমস্যা ছিল, চিকিৎসাও চলছিল। গত ১১ অক্টোবর সিলেটের আম্বরখানা বড়বাজার এলাকায় বাসার ছাদ থেকে পড়ে মো. আবদুল আউয়াল (৬২) নামের এক বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়। স্থানীয় সিটি কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমেদ ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিহত ব্যক্তি বেশ কয়েক বছর আগে হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন, এরপর আমেরিকায় পাড়ি জমান। সেখান থেকে ফিরে এসে ব্যবসা শুরু করলেও তিনি বেশ কিছুদিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, চিকিৎসাও চলছিল।
এগুলো অনেক ঘটনার কয়েকটি মাত্র। ঘটনাগুলো স্রেফ আত্মহত্যা না ওষুধ-উদ্গত আত্মহত্যা (মেডিসিন ইনডিউসড সুইসাইড)? বিষণ্নতা দূর করার বহুল ব্যবহৃত ওষুধের সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে, এটা রোগীর আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে। এসব ওষুধের কাগজে খুব পরিষ্কার করে লেখা আছে, এটা আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই খুবই সতর্কতার সঙ্গে এটা ব্যবহার করতে হবে। বিষণ্নতা দূর করার জন্য শিশু-কিশোর-তরুণদের এ ওষুধ দিলে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝোঁক আর চিন্তা প্রসারিত হতে পারে। বিষণ্নতায় ভোগা কোনো ব্যক্তির ওপর এ ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করতে চাইলে খুবই সতর্কতার সঙ্গে ক্লিনিক্যাল চাহিদাগুলো আমলে নিয়ে সেটা করতে হবে, অন্যথায় নয়।
আমরা ওষুধের সঙ্গে থাকা কাগজ পড়ি না, পড়তে দুই থেকে তিন মিনিটের বেশি লাগে না। পড়ি না, কারণ, মনে করি, আমি ওসবের কী বুঝব। চিকিৎসকদের আমরা সাধারণত জিজ্ঞাসা করি না এই ওষুধ কেন দিচ্ছেন? এটা না খেলে কী হবে? খেলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে? কত দিন খাব? বিষণ্নতার চিকিৎসায় ছিলেন, এমন ব্যক্তিদের আত্মহত্যার ঘটনার পর ঘটনাগুলোর তদন্ত ও এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক