যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ হয় আজীবনের জন্য; অর্থাৎ যত দিন তাঁদের মৃত্যু হবে না, তত দিন তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে থাকতে পারবেন। অবসরের বয়স বলে কিছুই নেই। আজীবন বা আমৃত্যু থাকতে পারবেন বলে তাঁরা কি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিচারপতির পদ আগলে ধরে রাখেন? না! এ কথা ঠিক যে বহু বছর পদে বহাল থাকেন। তিন-চার দশক ধরে দেখছি, সাধারণত ৮০ বছরের কমবেশি বয়স হলে তাঁরা অবসরে চলে যান। পদ থেকে সোজা কবরে গেছেন এমনটি বহু বছর শুনিনি; অর্থাৎ সাংবিধানিক পদগুলো সাধারণ চাকরি-বাকরির মতো ব্যাপার না; সাধারণ চাকুরেদের মতো অবসরে যাওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত পদে থাকতে হবে না।
আসি সংসদের কথায়। আমরা সবাই জানি, সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর। মেয়াদ পাঁচ বছর অর্থ একটা সংসদের কার্যকাল সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। এর এক দিনও বেশি না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সংসদ কি ৪ বছর ৩৬৪ দিন বহাল থাকবে? আমাদের মতো সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে সাংবিধানিক প্রথা বা রীতি হলো পুরো পাঁচ বছর সংসদ সাধারণত বহাল থাকে না। রীতি বা প্রথা হলো মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছুদিন আগেই সংসদ ভেঙে দেওয়া।
২. সংসদের মেয়াদ বিষয়ে আমাদের সংবিধানের ৭২(৩)–এ বলা আছে। সেখানে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে...’। এই উপ অনুচ্ছেদের ইংরেজি অনুবাদে বলা হয়েছে, ‘আনলেস সুনার ডিজলভড্ বাই দ্য প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট শ্যাল স্ট্যান্ড ডিজলভড্ অন দ্য এক্সপায়ারেশন অব দ্য পিরিয়ড অব ফাইভ ইয়ারস ফ্রম দ্য ডেট অব ইটস ফার্স্ট মিটিং...।’
এখানে মূল কথা হলো ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিলে...’। সংসদীয় রীতি বা প্রথা ধরেই নেয় যে সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে রাষ্ট্রপতি মেয়াদ পূর্তির কিছুদিন আগেই সংসদ ভেঙে দেবেন। কারণ, ভেঙে না দিয়ে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে নির্বাচনে বহাল সাংসদেরা তাঁদের নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক এবং শক্তিশালী অবস্থানে থেকে নির্বাচন করতে পারবেন। খেলাটা হবে অনেকটা লিগের প্রথম বিভাগের দল বনাম তৃতীয় বিভাগের দল।
আমাদের মতো আমাদের আশপাশে এবং দূরের সংসদীয় পন্থার দেশের সংবিধানগুলো মোটামুটি একই ভাষায় সংসদের মেয়াদ নির্ধারণ করেছে। ওই সব দেশের সংবিধানেও বলা আছে, ‘আনলেস সুনার ডিজলভড্’, অর্থাৎ পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিলে। সব দেশেই সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপ্রধানের, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি), রানি (যুক্তরাজ্য, কানাডা), সম্রাটের (জাপান) ইত্যাদি।
উদাহরণস্বরূপ ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮৩(২)–এ বলা আছে, ‘দ্য হাউস অব দ্য পিপল, আনলেস সুনার ডিজলভড্, শ্যাল কন্টিনিউ ফর ফাইভ ইয়ারস।’ একইভাবে পাকিস্তানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮(১)-এ বলা আছে, ‘...দ্য ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি শ্যাল, আনলেস সুনার ডিজলভড্...’; অর্থাৎ আমাদের অনুচ্ছেদ ৭২(৩)-এর মতো উপরোল্লিখিত দেশগুলোর সংবিধানে রাষ্ট্রপতি আগে ভেঙে না দিলে সর্বোচ্চ মেয়াদ কত বছর হবে, সেটা নির্ধারণ করা আছে।
এসব দেশে প্রধানত আমাদের অনুচ্ছেদ ৫৭(২)–এর অনুরূপ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থার ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। তবে আমাদের মতোই অনাস্থা ছাড়া অন্য কোনো কারণে, ক্ষেত্রে বা প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের সংসদ ভেঙে দেওয়াকে বারিত বা নিষিদ্ধ করা হয়নি; অর্থাৎ অনাস্থা হলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার বিধান করে এটা বোঝানো হয়নি যে ‘অনাস্থা পরিস্থিতি’ ব্যতীত অন্য কোনো অবস্থায় সংসদ ভেঙে দেওয়া যাবে না।
৩. অলিখিত সংবিধানের দেশ, অর্থাৎ যুক্তরাজ্যে সংসদের মেয়াদ, ভেঙে দেওয়া, নির্বাচনের তারিখ ইত্যাদি ব্যাপারে ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্টস অ্যাক্ট পাস হয় ২০১১ সালে এবং যুক্তরাজ্যের সংসদে প্রথম পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে নির্বাচন হয় ৭ মে ২০১৫। সেই ৭ মে ২০১৫–তে নির্বাচিত সংসদ ওই আইন অনুযায়ী ২০২০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বহাল থাকতে পারত। কিন্তু যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের অনুরোধে রানি এলিজাবেথ (দ্বিতীয়) দুই বছরের মাথায় ওই সংসদ ভেঙে দেন এবং ৭ জুন ২০১৭ সালে পুনরায় সংসদ নির্বাচন হয়।
৪. আগেই বলেছি, সংবিধানে সংসদসংক্রান্ত দুটি বাধ্যতামূলক বিধান থাকে। প্রথমটি হলো সংসদের সর্বোচ্চ মেয়াদ, যেমন আমাদের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর। আর দ্বিতীয় বাধ্যতামূলক বিধান হলো সরকারের বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। অনাস্থা প্রস্তাবের পর আর কী কী পরিণতি হতে পারে, সে ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সংবিধানে ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু বিস্তারিত বলা আছে। কিন্তু শেষ কথা হলো ‘নো কনফিডেন্স, নো পার্লামেন্ট।’ বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ ছাড়া পার্লামেন্ট ভাঙা যায় না।
সংসদের মেয়াদসংক্রান্ত সংবিধানগুলোতে ওপরের দুটি মূল কথার বাইরে যেটা বহুল প্রচলিত সাংবিধানিক প্রথা (কনস্টিটিউশনাল কনভেনশন) সেটা হলো, সুষ্ঠু ও সব দলের মধ্যে ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা। সংসদীয় গণতন্ত্রে সব দেশে সব সময় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন হয়েছে—এমন কথা হলফ করে বলা মুশকিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে; অর্থাৎ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রথার ব্যত্যয় ঘটেছে। সেগুলো ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রম। ন্যায্য প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়াটাই সঠিক অভ্যাস।
শেষের কথা: সংবাদমাধ্যম থেকে জানলাম যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংসদ রেখেই নির্বাচন হবে। এই সিদ্ধান্তের এখতিয়ার সম্পূর্ণ তাঁর একার; অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবং সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই ১১তম সংসদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তবে এটাই চূড়ান্ত।
ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক