করোনা সংক্রমণের বর্তমান ঊর্ধ্বগতি নিঃসন্দেহে আবারও চরম উদ্বেগের বিষয়। আর অমিক্রনের চোখ রাঙানি তো আছেই। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট ২০২০ কিংবা ২০২১ সালের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন। ২০২০ সালে করোনা মোকাবিলার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় শুরুতে আমরা অনেক পিছিয়ে ছিলাম। ২০২১ সালে তা অনেকটা গুছিয়ে আনা সম্ভব হয়। তবে টিকাদান শুরু হলেও টিকাস্বল্পতার পাশাপাশি টিকা গ্রহণে অনেকের অনীহার কারণে ডেলটা ভেরিয়েন্টের দোর্দণ্ড প্রতাপ দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ২০২২ সালে এসে আমরা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছি। আমাদের একদিকে যেমন আছে করোনা ব্যবস্থাপনার দুই বছরের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে শিক্ষার্থীসহ জনগণের বড় একটি অংশ ইতিমধ্যে টিকার আওতায় এসেছে।
সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা হলো টিকার বড় ধরনের একটি মজুত আছে। পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখন আর কোনো অনিশ্চয়তা নেই। এখন দরকার সবাইকে দ্রুত টিকার আওতায় আনা। আর এ জন্য বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার বিষয়ে কোনো অনিশ্চয়তা থাকার কথা নয়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে এ সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা চাই। দেশে এখন ২০২০ কিংবা ২০২১ সালের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আশা করি, তেমনটি আর হবেও না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকাই বেশি যুক্তিসংগত।
আর পরিস্থিতি খারাপ হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়; বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে ১২ বছরের ঊর্ধ্বে যেসব শিক্ষার্থী এখনো টিকা পায়নি, তাদের টিকার আওতায় আনা অনেকটা সহজতর হবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে করোনা সংক্রমণের হার এখন অনেক বেশি, তারা এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেছে। আর শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার পরও যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি খোলা না যায় কিংবা যতটুকু খোলা আছে তা–ও অব্যাহত রাখা না যায়, তাহলে ভরসার জায়গা তো আর অবশিষ্ট থাকে না। করোনার এই মৌসুমি খেলা যদি চলতেই থাকে, তাহলে কি বছরের আট মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে এবং বাকি চার মাস সীমিত পরিসরে চালু থাকবে? তা নিশ্চয় কাম্য নয়।
যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে বেশির ভাগ মানুষ টিকার আওতায় আসার পরও সেখানে করোনার মৌসুমি সংক্রমণ বন্ধ হয়নি। তাই যদি আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরও করোনার মৌসুমি সংক্রমণ বন্ধ না হয়, তাহলে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো করোনার সঙ্গে বসবাস করা ছাড়া আমাদের আর কীই-বা করার থাকবে। করোনা মৌসুমি রোগ হিসেবে দীর্ঘদিন থাকবে—এটাকে ধরে নিয়েই আমাদের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। তবে সবাইকে আবশ্যিকভাবে টিকার আওতায় আসতে হবে এবং মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরি এবং কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহসহ করোনা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে এখন যতটুকু খোলা আছে, তা–ও যদি আবারও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে নামসর্বস্ব যতটুকু শিক্ষা চালু আছে, সেটাও আবার অনিশ্চয়তার অন্ধকারে পতিত হবে।
করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গত দুই বছরে প্রাক্-প্রাথমিক অর্থাৎ প্লে গ্রুপ ও নার্সারি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তো শিক্ষাজীবন শুরু করতেই পারেনি। জাতীয়ভাবে এই ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করা না হলেও আমাদের যাদের ঘরে স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী আছে, তাদের কাছে ক্ষতির অঙ্কটা সহজেই বোধগম্য। পরিকল্পনাবিহীন শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি নষ্ট ছাত্ররাজনীতি, ধ্বংসাত্মক শিক্ষকরাজনীতি ও নিয়ন্ত্রণহীন কোচিং-বাণিজ্যের জাঁতাকলে শিক্ষার গুণগত মান কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে এখন যতটুকু খোলা আছে, তা–ও যদি আবারও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে নামসর্বস্ব যতটুকু শিক্ষা চালু আছে, সেটাও আবার অনিশ্চয়তার অন্ধকারে পতিত হবে।
মানবসম্পদের উৎকর্ষ সাধন করা ছাড়া আমাদের উন্নত হওয়া কিংবা উন্নতি সুসংহত করা—কোনোটাই সম্ভব নয়। আজকের শিক্ষার্থীরাই রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মূল কর্ণধার হিসেবে গড়ে ওঠার কথা। রূপকল্প ২০৪১ দক্ষ জনবল ছাড়া কি অর্জন করা সম্ভব হবে? তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার বিষয়ে আমাদের আপসহীন হতে হবে। আর অভিভাবকদের ভূমিকা এখানে অনেক বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার বিষয়ে অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হতে হবে। হুজুগে গা ভাসালে চলবে না। আমরা সবাই চাইলে সরকারের পক্ষে বর্তমান সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা সহজ হবে। তাই চলুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করি।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক