রোজিনা–কাণ্ড থেকে কিছু শিক্ষা

গত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে আমলাদের সক্রিয় ভূমিকা লোকমুখের আলোচিত বিষয় ছিল। নির্বাচনের পর তাঁদের অনেকের আচরণে ক্ষমতার আঁচ বোঝা যাচ্ছিল। কেউ কেউ বুঝিয়ে দিতেন তাঁরাই সরকার এনেছেন। আদতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার এবং অবসর-পরবর্তী জীবনে রাজনীতি তথা ক্ষমতাচর্চায় যুক্ত হওয়ার ঘটনা কেবলই বেড়েছে। অনেকেই চাকরিতে থেকে নির্বাচনী এলাকা গুছিয়ে নেন। এভাবে আমলা ও রাজনীতিকের মধ্যে যোগাযোগ ও সখ্য বেড়েছে, যা ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছে। এ মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে রোজিনা–কাণ্ডে। তাঁর জামিন পেতে ছয় দিন লাগাও ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের ঘটনাটি সম্পর্কে সাবেক আমলা ও বর্তমান মন্ত্রীও বলেছেন যে এটি দুঃখজনক এবং এতে সংশ্লিষ্ট আমলাদের অদক্ষতারই পরিচয় মিলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আমলাদের অদক্ষতার বিচিত্র পরিচয় করোনার সূচনা থেকেই মানুষ জেনেছে, আর উচ্চ থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতির খবরে ছিল বিস্ময় ও চমকের নানা উপাদান। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, এটি মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের প্রিয় আপ্তবাক্য। তবে জনগণ ঠিক বুঝতে পারে না আইনের এই নিজস্ব গতি কখন মন্থর হয়, কখন তা দ্রুততা পায়, আবার কখন একদম থেমে যায় বিকল গাড়ির মতো। রোজিনার ক্ষেত্রে কার ভূমিকা আইনি, কেই-বা বেআইনি কাজ করেছেন, জনমনে সেটাই বড় প্রশ্ন। আবার ‘বেআইনি’ কাজ বুঝতে পেরেও আমলারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর প্রথমেই ভরসা করেননি, নিজেরা কিছু ‘শিক্ষা’ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পরে তাঁকে আইনের কাছে সোপর্দ করেছেন। এ ঘটনাপ্রবাহ একটি গুরুতর বার্তা দিচ্ছে, প্রশাসনের নানা স্তরে ক্ষমতার দম্ভ ও দাপট এবং সেই সুবাদে দুর্নীতি বেপরোয়া পর্যায়ে পৌঁছেছে।

প্রশ্ন হলো, এই বার্তা আমলানির্ভর সরকারের চোখে ধরা পড়ছে কি না। তবে দু-একজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা যে ইশারা বুঝতে পারছেন, সেটা আমরা বুঝেছি, সরকারপ্রধানও তা নিশ্চয় বুঝবেন। দেশের নাগরিক সমাজের যে অংশটি পঁচাত্তরের পর থেকে ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ফেরানোর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, বর্তমান সরকারের পাশে রয়েছে, তাদেরও কিন্তু এ ঘটনায় দ্বিধা কাটিয়ে মুক্ত সাংবাদিকতার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হচ্ছে। ইতিহাসের এটাই নিয়ম। অনিয়ম কিংবা ক্ষমতার অন্ধ প্রতাপ, তা ক্ষমতার যে অংশ থেকেই আসুক, কারও পক্ষেই নীরবে সহ্য করা সম্ভব নয়। বরং এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে সমাজের ডিজিটাল অপরাধ বন্ধ করতে গিয়ে ক্রমেই যে সমালোচনার জায়গায় হাত যাচ্ছে, তাকে অগণতান্ত্রিক আচরণ আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠও জোরদার হচ্ছে, আরও হবে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে শাসক ও ক্ষমতাধরেরা সমালোচনা ও বিদ্রূপের প্রতি সহনশীল হন, অনেকে এ থেকে শিক্ষাও নেন। আমাদের দেশে রাজনৈতিক কার্টুন এখন বিলুপ্ত ধারা বলেই গণ্য হচ্ছে। অথচ এটি সমাজের গণতন্ত্রচর্চার পরিবেশের একটি নির্ণায়ক।

এর মধ্যেও বাস্তবতার প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এ দেশটি মুক্তিযুদ্ধের ফসল হলেও কখনো সমাজকে সে আদর্শে ঢেলে সাজানো যায়নি, ফলে সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও বাধ্যতা থাকলেও রাষ্ট্র তেমনভাবে চলতে পারেনি। বরং পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রের পদক্ষেপ চলেছে উল্টো পথে এবং সমাজ জানান দিয়েছে, তারও অভিপ্রায় সে রকম। বহুকাল পরে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এল, তখন সমাজ আরও রক্ষণশীল, তার পক্ষে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো রাষ্ট্রকে ধারণ বেশ কঠিন। ধর্মীয় রক্ষণশীলতার উত্থান এবং বাম প্রগতিশীল শক্তির অবক্ষয় যুগপৎ ঘটেছে। মধ্যকার তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে সমাজের অবশিষ্ট প্রগতিশীল অংশটির জন্য টিকে থাকার এবং এগোনোর অবলম্বন হিসেবে বর্তমান সরকার ছাড়া আর কোনো বিকল্পও ছিল না। তারা সরকারের সহযোগী হয়েই থাকল।

কিন্তু সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা রাজনীতিকও। তবে একালের রাজনীতিক, যখন ক্ষমতায় ফেরা ও তা ধরে রাখাই মুখ্য কাজ রাজনীতির। তাঁরা বোঝেন সমাজে বর্তমানে প্রগতিপন্থী মানুষ কম, তাঁদের অনুসারীও কম। একজন মন্ত্রী এই বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েই একটি মুক্ত আলোচনায় বোঝাতে চেয়েছিলেন, কেন সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রগতিবাদীদের পরামর্শ রেখে হেফাজতের কথা শুনেছিল। তবে যারা ষাটের দশক দেখেছি, তখনকার সব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত থেকেছি, তারা জানি এভাবে ক্ষমতাচর্চা হয়, রাজনীতি নয়। মনে হয়, রাজনীতিকদের এমন ভাবনাতেই সংকটের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে।

রাজনীতির মূল লক্ষ্য তো রাজনীতিই, যা জনগণের কল্যাণ সাধন করে আশু এবং দীর্ঘমেয়াদি—উভয় কল্যাণই এর লক্ষ্য। ক্ষমতা হলো রাজনীতির উপজাত। আজকালকার রাজনীতিকেরা অবশ্য বলে থাকেন, ‘ক্ষমতায় না গিয়ে আমাদের কর্মসূচি কীভাবে বাস্তবায়ন করব?’ এখন প্রশ্ন তোলা যায়, ক্ষমতায় গিয়ে কী করা গেল? তাহলে হেফাজতের সঙ্গে আপস করতে হয় কেন, কেন সংগঠন ছেড়ে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে? কারণ, রাজনীতির যে মুখ্য অবলম্বন ক্ষমতা নয় জনতা, তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে, হচ্ছে। ছয় দফার আন্দোলনের আগেই সেই ভাষা আন্দোলন থেকে এ দেশে ছাত্র-জনতা প্রগতির রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়েছেন, তাঁদেরই আকাঙ্ক্ষায় পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা। রাজনীতিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব তো এখানেই যে তিনি যথাসময়ে জনগণের প্রবণতা বুঝতে পেরেছেন এবং একই সূত্রে যথাযথ কার্যক্রম দিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে সেটি বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছেন, বাধা অতিক্রমের সাহস ও প্রেরণা জোগাতে পেরেছেন। সেই ঐক্য দুর্জয় ঐক্য, সাহস ও প্রেরণার ফসল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ-ই হলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

তরুণ মন্ত্রীরা যা ভাবেন, সেটা তো আপসের রাজনীতি, অথচ বঙ্গবন্ধু করেছেন আকাঙ্ক্ষার রাজনীতি; তাঁরা করছেন ক্ষমতার রাজনীতিচর্চা, বঙ্গবন্ধু করেছেন জনতার রাজনীতি। তবে আশার দিকও আছে, সরকার ঠকে হলেও জেনেছে হেফাজতের প্রকৃত রূপ এবং বুঝেছে তাদের করণীয়।

দুই দশকের স্বৈরশাসন ও পরবর্তী জামায়াত-বিএনপির শাসন থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার এনেছিল জনগণই। তাঁরা পরিবর্তন চেয়েছিলেন, দেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সফল ও সম্পন্ন হোক, তা চেয়েছিলেন। ফলে ২০০৮ সালে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল । এরপর এ সরকারের দীর্ঘ শাসনকালে উন্নয়ন যে হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ হলো বস্তুগত উন্নয়ন, যার প্রয়োজন অনস্বীকার্য, কিন্তু এ হলো ভোগের; জনমানসের, মানবসম্পদ ও মানস-সংস্কৃতির উন্নয়নের নয়। তাই শিক্ষার মানোন্নয়নে এখনো আমরা ব্যর্থই বলা যায়। মানবসম্পদ উন্নয়নেও সফল নই এবং দুর্নীতি কোনোভাবেই বন্ধ হয় না, প্রশমনও করা যায় না।

আইন না মানা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং এরই ফাঁকে আমলাতন্ত্রের বেসামরিক, আধা সামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্রের শক্তি বেড়েছে, কারও কারও সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক বেড়েছে। যোগফল গণতন্ত্রের সংকোচন, আইনের শাসনের সংকট, মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন। আর ঘটেছে দুর্নীতি ও ক্ষমতার প্রতাপ বৃদ্ধি। বাংলাদেশের জনগণ উন্নয়ন চায় কিন্তু এর জন্য পূর্বার্জিত ফসল গণতন্ত্র বা সুশিক্ষা ও সুশাসনের মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক মানবিক সরকার ও সমাজের আকাঙ্ক্ষাকে জিম্মা রাখতে পারবে না। আদতে বর্তমান পথে প্রত্যাশিত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

রোজিনা–কাণ্ড বিভক্ত সাংবাদিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং সেই ঐক্য ও ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া আইনের মন্থরগতিকে সচল করতে সক্ষম হয়েছে। এরপর আইনি পথে নিষ্পত্তির মাধ্যমে রোজিনা কি চূড়ান্ত মুক্তি পাবেন, নাকি সবটাকেই বিস্মৃতিতে ঠেলে দিয়ে সব পক্ষকে বিব্রত অবস্থা থেকে মুক্তি দেবে! আইনের গতিপ্রকৃতির এমন পরিণতি আমরা আগেও দেখেছি।

প্রগতিপন্থী যে মানুষগুলোর কথা আগে বলেছি, তাঁরা আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের ক্ষেত্রে এড়িয়ে থাকলেও রোজিনার ক্ষেত্রে রাজপথে তাঁদের নামতেই হয়েছে, স্পষ্ট অবস্থানে দাঁড়াতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে হলে এবং বর্তমান সরকারকে সেই আদর্শ ধরে রাখতে হলে করণীয় সম্পর্কেও পথ দেখাল এ ঘটনা—আদর্শের সঙ্গে যেকোনো অসংগতি বা প্রশাসনিক অন্যায়কে চুপচাপ সয়ে যাওয়া যাবে না এবং ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধেরও কোনো বিকল্প নেই। বোঝা গেল নিবর্তনমূলক আইন নয়, তথ্য অধিকারের মতো মুক্তচিন্তার অনুকূল আইনই দরকার।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক