২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার দুই শাসকের কেন ‘গলায়–গলায় দোস্তি’

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন
ছবি : এএফপি

গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর, প্রথমবারের মতো কোনো রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হিসেবে ৭-৮ জানুয়ারি দেশটি সফর করেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট ‘আসিয়ান’–এর চলতি বছরের চেয়ার পদে আসীন হয়েছে কম্বোডিয়া। আসিয়ানের আনুষ্ঠানিক কোনো অ্যাজেন্ডা না থাকলেও মিয়ানমারের চলমান অচলাবস্থা বিষয়েই তাঁর এ সফর বলে মনে করা হচ্ছে। সফরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও হুন সেন মহাসমারোহে তাঁর পাঁচ মন্ত্রী, সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান, দুজন উপমন্ত্রী এবং একদল প্রতিনিধি নিয়ে মিয়ানমার সফর করেন। এ সফরে মিয়ানমার জনগণের প্রাপ্তির চেয়ে দুই দেশের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারপ্রধানের স্বার্থই হাসিল হয়েছে।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনী অনার গার্ড ও লালগালিচা দিয়ে হুন সেনকে অভ্যর্থনা জানালেও মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থীরা এ সফরের বিরোধিতা করে বিভিন্ন স্লোগান এবং বোমা ফাটিয়ে প্রতিবাদ জানান। অভ্যুত্থানবিরোধীদের বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এ আশঙ্কায় যে হুন সেনের সফর নিষ্ঠুর জান্তা শাসককে আরও বৈধতা দেবে। আর এ সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্যও তা–ই বলে মনে করা হচ্ছে। হুন সেন ও মিন অং হ্লাইংয়ের মধ্যে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বিষয়, আসিয়ান–সমর্থিত পাঁচ প্রস্তাব, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে মিয়ানমারে কারাবন্দী অস্ট্রেলিয়ান অর্থনীতিবিদ শন টার্নেলের (অং সান সু চির সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা) মামলা এবং করোনা মহামারি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ বা তাঁর মুক্তির বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বা হবে না বলে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল কম্বোডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

হুন সেনের সফরের উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলে সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় আসিয়ানের বিশেষ দূতকে যোগ দেওয়ার অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছে জান্তা বাহিনী। তবে আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্যের কোনোটিই সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সফর।

এ সফর থেকে মিয়ানমারে ‘গৃহযুদ্ধ’ পরিস্থিতি নিরসনে আশাব্যঞ্জক কোনো রূপরেখা পাওয়া যায়নি। সফরের পর একপক্ষীয় ঘোষণায় মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, বিভিন্ন সশস্ত্র জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি বছরের শেষ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। যদিও এর কোনো বাস্তবিক ফলাফল পরিলক্ষিত হয়নি। সাগাইং, শিন, কায়াহ, কা-ইন রাজ্যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী অযাচিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, ফলে ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় অর্ধলাখ মানুষ। মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে সামরিক বাহিনী সহযোগিতা করবে বললেও উল্টো তারা ‘ফোর-কাট’–এর মতো বীভৎস নীতি অবলম্বন করে সব ধরনের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ করে রেখেছে।

সেনাবাহিনীর এ নীতি ১৯৭০-এর দশকে বার্মিজ সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির সাবেক শাসনামলে তৈরি করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য হলো খাদ্য, তহবিল, তথ্য এবং কর্মী নিয়োগের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে জাতিগত মিলিশিয়াদের দুর্বল করা, যার পরিণতি প্রায়ই ধ্বংসাত্মক হয়ে থাকে। এখন সেনাবাহিনী সাধারণ জনগণকে ‘বর্ম বা ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে গণতন্ত্রপন্থী গেরিলা দল ‘পিডিএফ’ ও নৃতাত্ত্বিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর আক্রমণ করছে। হুন সেনের সফরের উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলে সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় আসিয়ানের বিশেষ দূতকে যোগ দেওয়ার অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছে জান্তা বাহিনী। তবে আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্যের কোনোটিই সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সফর।

এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, হুন সেন তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবি কীভাবে বদলাবেন? হুন সেন এবং মিন অং হ্লাইং উভয়েই নিজ নিজ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত। কম্বোডিয়ার রাজনীতিবিদ ও সাবেক সামরিক কমান্ডার হুন সেন ১৯৮৫ সাল থেকে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কম্বোডিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সরকারপ্রধান এবং বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসকদের একজন। হুন সেন কম্বোডিয়ার একমাত্র রাজনৈতিক দল ‘কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি’র (সিপিপি) সভাপতিও। আসিয়ানে মিয়ানমারের ছায়া জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) রাষ্ট্রদূত বো হ্লা টিন্ট বলেন, ‘এটা হাস্যকর যে দুই ব্যক্তি, যাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী; তাঁরা শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তির জন্য আলোচনায় নিযুক্ত হচ্ছেন।’ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন বলেছেন, হুন সেন মিয়ানমারকে ব্যবহার করছেন তাঁর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে দূর করার জন্য। তিনি সংবিধানে ড্রাকোনিয়ান ধারা অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিদ্বন্দ্বী কম্বোডিয়ান ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টির (সিএনআরপি) মতো সব বিরোধী দল বিলুপ্ত করেন। ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাঁর ‘সিপিপি’ দল প্রতিটি আসনে জয়লাভ করে। তখন থেকে সাংবাদিক, পরিবেশবাদী এবং সুশীল সমাজের কর্মীদের পাশাপাশি কয়েক শ সিএনআরপি–সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জেলে পাঠানো হয়েছে।

গণতন্ত্র ধ্বংস করে একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার চর্চা, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অনুগত না হলে অযাচিত ও নৃশংসভাবে হত্যার ঘোষণার মতো যেসব কর্মযজ্ঞে মিন অং হ্লাইং এখন লিপ্ত, তার প্রায় প্রতিটিতেই সিদ্ধহস্ত হুন সেন। ১৯৯৭ সালে কম্বোডিয়ায় ক্যু ঘটিয়ে আবার ক্ষমতায় আরোহণ করা হুন সেনের মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ও দীক্ষা তাই বেশ ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। আবার মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার বর্তমান সামরিক শাসকদের সঙ্গে রয়েছে চীনের ঘনিষ্ঠতা। ২০২১ সালে ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রতি আসিয়ানের কঠোর অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও উদ্বিগ্ন করে চীনকে। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রের পক্ষে সরব আসিয়ানভুক্ত মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইন কিছুটা নীরব ভূমিকা পালন করবে চলতি বছর, এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে। কম্বোডিয়া আসিয়ানের দায়িত্ব গ্রহণের পরপর তার উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাক শুখুনকে ‘আসিয়ানের মিয়ানমার–বিষয়ক বিশেষ দূত’ হিসেবে নিয়োগ করে। ফলে আসিয়ানের সভাপতি হিসেবে হুন সেন ও তাঁর বিশেষ দূত হিসেবে প্রাক শুখুন যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকেই প্রাধান্য দেবেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

হুন সেনের এ সফরের পেছনে আসিয়ানের বাকি আটটি দেশের সমর্থন না থাকায় ‘মিয়ানমার সংকট’ নিরসনে আসিয়ানের আগেকার গৃহীত পদক্ষেপগুলো বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। মিয়ানমার ইস্যুতে ‘পাঁচ দফা’ পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ব্যর্থতা আসিয়ানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হুন সেনের তৎপরতা সংস্থাটির বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ১৮-১৯ জানুয়ারি আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্ভাব্য অনানুষ্ঠানিক সমাবেশে মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করবে কম্বোডিয়া৷ এর মাধ্যমে আসিয়ানের বার্ষিক সম্মেলন এবং আসিয়ান রাষ্ট্রপ্রধান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে ওয়াশিংটনে সম্ভাব্য বৈঠকে মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হতে পারে। হুন সেন এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় নিজের স্বৈরতান্ত্রিক উদ্যোগগুলোকেও আন্তর্জাতিক মহলে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া যে এখন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

তন্ময় চৌধুরী গবেষক ও লেখক। [email protected]