মানুষ ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে করে খাচ্ছে আর আমি...

শিউলী বেগম (৩৫)। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার সরকার বাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় তিনবার ভাইভা দেন। আরও নানা নিয়োগ পরীক্ষা দিতে দিতে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর এনটিআরসিএর দশম নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করেন। এখন সনদ অর্জন করেও বেকার। খরখরিয়া গ্রামে এক দাখিল মাদ্রাসার কমিটিকে এক লাখ টাকা দিয়ে রেখেছেন। সেই টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না কমিটির সভাপতি।

শিউলী বেগম বলেন, ‘আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ! প্রাইমারি পরীক্ষা যখন লিখিত ছিল, তখন তিনবারই ভাইভা পর্যন্ত গেছি, আর যেই এমসিকিউ হলো, মুঠোফোনের মেসেজে নকল সাপ্লাই শুরু হলো, আর পারলাম না। এদিকে এনটিআরসিএতেও একই ঘটনা। আমি ৪০ নম্বর পেলাম তো, নম্বরের ভিত্তিতে মেধাতালিকা শুরু হলো। কত মানুষ ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়া করে খাচ্ছে, আর আমি এত সার্টিফিকেট নিয়া...।’

জয়নুল আবেদীন (৪৩), বাড়ি চিলমারী। বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স। তিনি কলেজ পর্যায়ে তৃতীয় নিবন্ধনধারী। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৬০। এনটিআরসিএর পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে মেধাতালিকার নির্দেশনা দিলে তিনিও ছিটকে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় নির্দেশনা ছিল এমসিকিউ ও লিখিত মিলে গড়ে ৪০ নম্বর পেলেই চলবে। ওই নম্বরেই কর্তৃপক্ষ আমাদের চাকরি দেবেন। ফলে আমরা ওভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।’

নিবন্ধনধারী ১৬৬টি গ্রুপ হাইকোর্টে কর্তৃপক্ষকে যে কয়টি ধাপে মোকাবিলা করেছেন, শেষেরটি ছাড়া সব কটি রায়ই তাঁদের পক্ষে গেছে। ৮০ বা ৯০টি কার্যদিবস ধরে তর্কবিতর্কের রায়গুলো নিবন্ধনধারী প্রার্থীদের পক্ষে গেলেও শেষের আধঘণ্টার শুনানির রায়টি কেবল রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষে গেছে। তারপর আর রিভিউ আবেদন করেননি নিবন্ধনধারীরা। অথচ হাইকোর্ট তাঁর রায়ের ৫ নম্বর পয়েন্টে ১-১২তমদের মেধাতালিকা করে প্যানেলভিত্তিক নিয়োগ দিতে বলেছেন। এনটিআরসিএর আইনজীবী জানিয়েছেন, তাঁরা ইংরেজি বাক্যের মানে বোঝেননি।

অনশনকারী প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়ছেই। দায়িত্বশীল সরকারি লোক কেউ এখন পর্যন্ত সেখানে যাননি। সংহতি জানায়নি নাগরিক সমাজও। এই বৃষ্টিবাদলার দিনে আমাদের সন্তানেরা ফুটপাতে বিছানো ত্রিপল মাথায় দিয়ে বৃষ্টি ঠেকাচ্ছেন। কারও এতটুকু দয়া হচ্ছে না!

২.

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের হাতে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পরিদর্শন ও নিরীক্ষায় সনদ জাল ধরা পড়েছে ১ হাজার ১৫৬ জনের। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে জাল সনদ দাখিল করেছেন ৭৯৩ জন। কম্পিউটার শিক্ষার ভুয়া সনদ দেখিয়েছেন ২৯৬ জন। ৬৭ জনের বিএড, গ্রন্থাগার, সাচিবিক বিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ের সনদ জাল। প্রথম আলোর এই প্রতিবেদন হচ্ছে ২০১৩ সালের আগের। কত টাকা বেতন হিসেবে তাঁরা তুলেছেন, সেটা রাষ্ট্রের হিসাব। কিন্তু সনদ জালের ঘটনা তো ২০১৩ সালেই থেমে ছিল, এমন নয়। তারপরের বছরগুলোতে সনদ জালের ঘটনা ঘটেছে। নিবন্ধনধারী প্রার্থীরা বলছেন, এই জাল সনদধারী প্রার্থীদের সংখ্যা বর্তমানে ৬০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর পদশূন্য আছে লক্ষাধিক।

৩.

সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে মেধাতালিকায় প্রত্যেক নিবন্ধনধারীকে প্রতিষ্ঠান পছন্দ করতে বলা হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বাবদ ১৩০ টাকা ফি ধরা হয়। কেউ কেউ শতাধিক প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত পছন্দ দেন। এ এক অদ্ভুত লটারি। দেখা যাচ্ছে, কেউ ২০টি প্রতিষ্ঠান পেয়ে যাচ্ছেন মানে ১৯ জনের জায়গা দখল করছেন। পরে ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে পরের বছর আবার শিক্ষকের চাহিদা এনটিআরসিএতে পাঠাতে হচ্ছে। অন্যদিকে কারও একটি প্রতিষ্ঠানেও হয়নি। আবার একই ব্যক্তি পরের বছর একই ঘটনা ঘটাচ্ছেন। স্বভাবতই যাঁরা ৪০ নম্বর প্রাপ্তির বছরগুলোতে পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁরা পরবর্তী বছরের প্রতিযোগীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন। সেই ১৯৫২ সালে ছাড়পত্র পাওয়া ঋত্বিক ঘটকের নাগরিক সিনেমার চাকরি সন্ধানী নায়কের পিতার সংলাপ, ‘জানিস খোকা একসময় লটারির টিকিট কিনতাম, এখন আর কিনি না। চাকরি পাওয়ার আশা হচ্ছে জুয়া খেলা। হাজারজন ঘুরছে, একজন পাবেই। কেউ নিজ প্রতিভা বা ক্ষমতার জোরে পায় না, হঠাৎ নম্বরটা লটারিতে উঠে গেছে বলে।’

আরও পড়ুন

কোর্ট-কাচারি পর্ব শেষ করে ভুক্তভোগীরা এখন শাহবাগে অনশনে বসেছেন। রাইহান কবির (৩৪), কাজ করেন পুরান ঢাকায়। বাড়ি কুড়িগ্রাম সদরের গঙ্গাধর নদের পাড়ে। তাঁর বিষয় ইংরেজি, প্রাপ্ত নম্বর ৭৭। তিনিও এসেছেন শাহবাগের অনশনে। লটারিতে তাঁর নামটি ওঠেনি। যশোরের ঝিকরগাছার নিবন্ধনধারী এক তরুণ অনশনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে লেখেন, ‘আপনাদের দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে সাধারণ নিবন্ধনধারী প্রার্থীদের জীবন থেকে সোনালি দিনগুলো হারিয়ে গেছে। আপনারা জাতীয় দুশমন।’

বাজারে চরম অস্থিরতা। তরুণদের চাকরি দরকার, দরকার বিয়ে। মানুষের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কটা বজায় রাখলে নাকি দুনিয়াটা ভাই ভাই হয়ে যায়। এই তরুণেরা যাঁরা শাহবাগে ‘সনদ যার চাকরি তার’ ব্যানার লিখে অনশনে বসেছেন, তাঁরা কিন্তু বুঝতে শিখছেন, এ বাজারে বাঁচতে হলে দল পাকাতে হবে। তাই প্রতিদিন অনশনস্থল বড় হচ্ছে। নাগরিকের নায়কের মতো তাঁরাও বলছেন, বেশি কিছু তো চাই না, সামান্য একটু সুখে জীবন কাটাতে চাই।

অনেক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষকের অভাবে স্থবির হয়ে আছে। ডিও লেটার দাতা সংসদ সদস্যরা তদবির করছেন নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটাই বাতিল করে আগের অবস্থায় ফিরতে। এদিকে এনটিআরসিএ–ও নিজেদের নাম বদলাতে চাইছে। তবু তারা লক্ষাধিক শূন্য পদে সনদধারী প্রার্থীদের প্যানেলভিত্তিক নিয়োগ দেবে না। এরই প্রতিবাদে ৫ জুন থেকে চলছে আমরণ অনশন। চতুর্থ দিন ড. জাফর ইকবাল সেখানে গিয়ে অনশন ভাঙার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করবেন তিনি। এতে কেউ কেউ অনশন ভাঙলেও নতুন করে অনশনকারী প্রার্থীদের সংখ্যা বাড়ছেই। দায়িত্বশীল সরকারি লোক কেউ এখন পর্যন্ত সেখানে যাননি। সংহতি জানায়নি নাগরিক সমাজও। এই বৃষ্টিবাদলার দিনে আমাদের সন্তানেরা ফুটপাতে বিছানো ত্রিপল মাথায় দিয়ে বৃষ্টি ঠেকাচ্ছেন। কারও এতটুকু দয়া হচ্ছে না!