আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির পর এক মাসের বেশি সময় চলে গেছে। এর মধ্যে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। শুরুতে সরকার যে অবস্থান নিয়ে এর বিরোধিতা শুরু করেছিল, এখন আর সেখানে আছে বলে মনে হয় না। এ সময়ে মন্ত্রীদের মুখে আমরা নানা কথা শুনেছি। এর মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখেই স্বাভাবিকভাবে বেশি কথা শোনা গেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধুরাষ্ট্রের তরফে যখন নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তখন সাংবাদিকেরাও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে যেখানে পাচ্ছেন, সেখানেই প্রশ্ন করছেন। তিনিও ডানে-বাঁয়ে ব্যাটিংয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্ব সাম্প্রতিক (গত শুক্রবার) বক্তব্যে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেল। ‘র্যাব তৈরি করেছে আমেরিকানরা আর ব্রিটিশরা।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তাদের (র্যাব) প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা শিখিয়েছে কীভাবে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, হাউ টু ইন্টারোগেশন (কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে)। এখন যদি এসবে কোনো সমস্যা হয়ে থাকে কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তাহলে আবার নতুন করে ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ) হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটা ধরে নেওয়া যায় যে র্যাবের মতো একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির ইচ্ছা বাংলাদেশ সরকারের ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের কারণেই এটি করতে হয়েছে। আর র্যাবকে যেহেতু প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তাই এই বাহিনীর দ্বারা যদি কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে থাকে, তবে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বড় সমস্যা রয়েছে। ফলে দায়টা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রেরই। এখন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে নতুন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, র্যাব সৃষ্টি কোন সময় হয়েছিল, এটা সবাই জানে। যারা র্যাব সৃষ্টি করেছে, তারাই র্যাবকে নিয়ে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ যখন র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমসহ সরকারি প্রতিক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব যে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে এবং তা কতটা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ফেলতে পারে, তা বিবেচনার মধ্যে ছিল না। র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমের দেশগুলোতে তাঁদের ভ্রমণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, সেসব দেশে তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনায় বিঘ্ন হতে পারে বা সেখানে সম্পদ থাকলে তা বাজেয়াপ্ত হতে পারে। কিন্তু র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর ভবিষ্যৎ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। তার কিছু দিক এরই মধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন সূত্রে আমরা জেনেছি, একটি সফটওয়্যার কেনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে র্যাবের কথা হচ্ছিল এবং নিষেধাজ্ঞা জারির পর বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান র্যাবের কাছে সফটওয়্যার বিক্রির সিদ্ধান্ত বাতিলের কথা জানিয়ে দিয়েছে।
আইনবহির্ভূত কাজের যেকোনো দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বাহিনীকে অবশ্যই নিতে হবে। কিন্তু এই ঘটনাগুলোর দায় কি শুধুই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা এর কিছু সদস্যের? র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি নিজেরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসব ঘটনা ঘটায় নাকি আইনশৃঙ্খলা দমনে তারা সরকারের নেওয়া নীতি বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটায়?
তবে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর প্রতিষ্ঠানটির জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুতর যে খবরটি এসেছে তা হচ্ছে, র্যাবকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম থেকে বাদ দিতে ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের চিঠি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে ল্যাকোঁয়ারকে পাঠানো এক চিঠিতে এই অনুরোধ করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এই চিঠির কথা স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবেই বিষয়টির দিকে নজর দেব। আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমাদের মানবাধিকার বিষয়ে কঠোর নজরদারি আছে, যা প্রতিটি দেশের প্রতিটি ইউনিটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।’
র্যাব বিএনপির আমলে তৈরি হয়েছে বা র্যাব গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন—মন্ত্রীদের তরফে এ ধরনের বক্তব্য আসলে বর্তমান পরিস্থিতির গভীরতার সঙ্গে ঠিক মেলে না। র্যাব কোন সরকারের আমলে তৈরি হয়েছে বা তাদের কারা প্রশিক্ষণ দিয়েছে—সামনের দিনগুলোর গতিপ্রকৃতি মোকাবিলায় তা খুব প্রাসঙ্গিক নয়। র্যাবের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম চলে সরকারের অধীনে, সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানকে সরকার কীভাবে ব্যবহার করছে, সেটাই হলো আসল কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি সংস্থার সূত্রে পাওয়া কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, র্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০টির বেশি গুম, ২০১৮ সাল থেকে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এসব পরিসংখ্যানের বাইরে দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে র্যাবসহ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে। আইনবহির্ভূত কাজের যেকোনো দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বাহিনীকে অবশ্যই নিতে হবে। কিন্তু এই ঘটনাগুলোর দায় কি শুধুই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা এর কিছু সদস্যের? র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি নিজেরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসব ঘটনা ঘটায় নাকি আইনশৃঙ্খলা দমনে তারা সরকারের নেওয়া নীতি বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ঘটায়?
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত অপরাধীদের হত্যার একটি নীতি যে সরকারের রয়েছে এবং তা যে চলে আসছে, সে ব্যাপারে আর যা-ই হোক জনমনে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের এ ধরনের অবস্থান নিয়ে কোনো রাখঢাক আছে বলেও মনে হয় না। সরকারি দলের নেতা, সাংসদ এমনকি মন্ত্রীদের মুখেও ‘ক্রসফায়ারের’ পক্ষে সাফাই শোনা যায়। গত নভেম্বরেই শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদারের মুখে বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে বক্তব্য শোনা গেছে। অনেক সময় বিরোধী নেতারা বলেন, ‘আমরা ক্রসফায়ার দিয়ে মানুষ হত্যা করছি। আমি ক্রসফায়ারের পক্ষে। এই জন্য পক্ষে, একজন সন্ত্রাসীর কারণে লাখ লাখ মানুষের ঘুম যেখানে হারাম হয়ে যায়, সেই সন্ত্রাসীর সমাজে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নাই।’
মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাবের দায়ের চেয়েও সরকারের দায়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। নিষেধাজ্ঞা হয়তো র্যাবের বিরুদ্ধে এসেছে কিন্তু এটা কার্যত এসেছে সরকার যে নীতির ভিত্তিতে র্যাবকে পরিচালনা করছে বা ব্যবহার করছে তার বিরুদ্ধে। সরকার যদি বিচারবহির্ভূত হত্যার নীতি থেকে সরে আসে, তবে কি র্যাবের পক্ষে সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করা সম্ভব?
একজন মন্ত্রীর মুখে এ ধরনের বক্তব্য দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে ক্ষুব্ধ করেছে, তারা বিবৃতি দিয়ে এর প্রতিবাদ করেছে। এরপরও মন্ত্রী কিন্তু তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসেননি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এ নিয়ে প্রশ্ন করলে কামাল মজুমদার তাঁর আগের বক্তব্যে অটল ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, যারা সমাজের লক্ষ লক্ষ মানুষকে জিম্মি করে রাখছে, যারা মদ-ইয়াবা নিয়ে ব্যবসা করে নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করছে, যারা চান্দাবাজি, টেন্ডারবাজি করছে, যারা মানুষকে ধ্বংস করছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা হরণ করছে, আমি তাদের ক্রসফায়ার দেওয়ার কথা বলছি।’
আমাদের মনে আছে সংসদে ধর্ষণকারীর ক্রসফায়ার চেয়েছেন জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও তরীকত ফেডারেশনের সাংসদেরা। সিলেট এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনার পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ অভিযুক্তদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার যদি সুযোগ থাকত, আমি এটাই বলতাম, এদের বিচারের কাঠগড়ায় নয়, এদের সরাসরি ক্রসফায়ারে দিয়ে দিতে।’
ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রকাশ্য এই অবস্থান অনেক কিছুই খোলাসা করে। ফলে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যতই বলুক ‘ক্রসফায়ার’ বলে কিছু নেই, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বলে কিছু নেই—একে জনগণ নিছক কথার কথা বলেই মনে করে। আর সবচেয়ে বড় কথা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও দুর্বৃত্তের দমনে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচারহীনতার কারণে জনমনেও ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে একধরনের সায় রয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বাস্তব পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং সরকার সেই নীতি বাস্তবায়নে র্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগাচ্ছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাবের দায়ের চেয়েও সরকারের দায়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। নিষেধাজ্ঞা হয়তো র্যাবের বিরুদ্ধে এসেছে কিন্তু এটা কার্যত এসেছে সরকার যে নীতির ভিত্তিতে র্যাবকে পরিচালনা করছে বা ব্যবহার করছে তার বিরুদ্ধে। সরকার যদি বিচারবহির্ভূত হত্যার নীতি থেকে সরে আসে, তবে কি র্যাবের পক্ষে সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করা সম্ভব?
মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় সরকারকেই নিতে হবে।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক