জাতীয় সংঘাতগুলো মূলত যুক্তিনির্ভর। অঞ্চল নিয়েই তাদের চিন্তা। সমঝোতার মাধ্যমে এর মীমাংসা সম্ভব। ধর্মীয় সংঘাত অযৌক্তিক। সব পক্ষই যখন পরম সত্যে বিশ্বাসী, তখন তাদের চোখে অন্য সবাই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অবিশ্বাসী, একমাত্র সত্য ঈশ্বরের শত্রু।
শুদ্ধ বিশ্বাসীদের মধ্যে সমঝোতা হয় না। কারণ তারা মনে করে, তারা ঈশ্বরের জন্য লড়ছে এবং তাদের হুকুম আসছে সরাসরি স্বর্গ থেকে। ক্রুসেডাররা ‘ঈশ্বর চাহেন’ ধ্বনি তুলে মুসলিম ও ইহুদিদের কচুকাটা করেছে। ‘আল্লাহ মহান’ রব তুলে উন্মত্ত মুসলিমরা কল্লা কাটে শত্রুদের।
জায়নবাদী আন্দোলনের জনকেরা সবাই ছিলেন সেক্যুলার ইহুদি ও ঘোষিত নাস্তিক। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে জায়নবাদী প্রচেষ্টা ধর্মজাত গোঁড়ামিমুক্ত ছিল। এখনো জঙ্গি জায়নবাদীরা ‘ইহুদি জনগণের জাতীয় রাষ্ট্রের’ কথাই বলে, ‘ইহুদি ধর্মরাষ্ট্রের’ কথা বলে না।
জায়নবাদী জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কঠিন বাধার মুখে পড়ে। প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে প্রায় সব আরব নেতা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। এই আরব প্রতিরোধের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক ছিল না। অল্প সময়ের জন্য ফিলিস্তিনের জাতীয় প্রতিরোধ জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি হাজ আমিন আল-হুসেনির নেতৃত্বে চললেও ধর্মীয় জোরে নয়, জেরুজালেমের সবচেয়ে অভিজাত বংশের নেতা হিসেবেই তিনি এটা করেছিলেন।
আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও সর্বদাই সেক্যুলার ছিল। এর স্বনামধন্য নেতাদের বেশির ভাগই ছিলেন খ্রিষ্টান। যে নিখিল আরব বাথ পার্টি সিরিয়া ও ইরাক শাসন করত, তাদের প্রতিষ্ঠাতারাও ছিলেন খ্রিষ্টান।
সে সময়ের আরব জনতার মহান নেতা, গামাল আবদ-আল-নাসের আচার-আচরণে মুসলিম হলেও ধর্মকর্ম করতেন না। ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠাবান মুসলিম হলেও তাঁর নেতৃত্বে পিএলও বেশ কজন খ্রিষ্টান নেতাসহ পুরোপুরি সেক্যুলারই ছিল। তিনি প্রায়ই জেরুজালেমের মসজিদ ও গির্জা দখলমুক্ত করার কথা বলতেন। তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন ফিলিস্তিন ছিল গণতান্ত্রিক ও বিশেষণমুক্ত।
তাহলে কেন মধ্যপ্রাচ্যের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো উগ্র ধর্মবাদী পথে বদলে গেল? ধর্মযাজিকা থেকে ইতিহাসবিদ হওয়া কারেন আর্মস্ট্রং মনে করাচ্ছেন, তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্ম ঘিরে একই সঙ্গে এমনটা ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা ডানপন্থী ইহুদি শক্তির যোগসাজশে রাজনীতিতে জোরদার প্রভাব ফেলছে। মুসলিম দুনিয়াজুড়েও মৌলবাদী আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে। আর ইসরায়েলে ইহুদি মৌলবাদ বড় থেকে আরও বড় আকারে জাতির ত্রাতার ভূমিকায় নেমেছে। যখন প্রায় সব ধর্মে এবং বহু দেশে একই ঘটনা ঘটছে, তখন তার নিশ্চয়ই গড়পড়তা কারণ আছে। সেটা কী? কী সেই যুগলক্ষণ?
মুসলিম দেশগুলোতে উদার, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ দেউলিয়া হয়ে সৃষ্টি করেছে আধ্যাত্মিক শূন্যতা, অর্থনৈতিক অধঃপতন এবং জাতীয় লাঞ্ছনা। নাসেরের জ্যোতির্ময় আশাবাদ হোসনি মোবারকের বন্ধ্যাত্বে পর্যবসিত হয়েছে। বাগদাদ ও দামেস্কের বাথপন্থী শাসকেরা আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থ। আলজেরিয়া ও তুরস্কের সামরিক সংস্কারকেরা ভালো কিছু দিতে পারেননি। ইরানের জাতীয়তাবাদী নেতা মোহাম্মেদ মোসাদ্দেককে উচ্ছেদ করে তেলগ্রাসী পশ্চিমা শক্তি ক্ষমতায় বসিয়েছিল রেজা শাহকে। সেই হতভাগাও দাবি মেটানোর অযোগ্য।
আর এই পুরোটা সময়জুড়ে আরবরা ভোগ করেছে ইসরায়েলের অত্যাচার। বাইরে থেকে রোপণ করা এই তুচ্ছ রাষ্ট্রটি দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাদের চোখের সামনে। বারবার আরবরা এর হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছে।
প্রতিটি নতুন যুদ্ধের পর মুসলিম জনতা নিজেদেরই জিজ্ঞাসা করেছে: ‘কী ভুল ছিল আমাদের?’ জাতীয়তাবাদ যদি শান্তি ও যুদ্ধ দুইখানেই ব্যর্থ হয়, যদি পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র দুই-ই অর্থনৈতিক ভরসা দিতে অক্ষম হয়, ইউরোপীয় মানবতাবাদ ও সোভিয়েত সাম্যবাদ কেউই যদি ওই আধ্যাত্মিক শূন্যতা ভরাতে না পারে, তাহলে কোথায় মিলবে সমাধান? জনতার গভীর থেকে বাজ পড়ার শব্দে উত্তর আসে: ‘ইসলামই দেবে উত্তর’।
যুক্তি বলে, ইসরায়েলিদের কাছে উত্তরটা হবে এর উল্টো: ইহুদি মৌলবাদ। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেই শুধু নয়, প্রাযুক্তিক ও আণবিক শক্তিতেও ইসরায়েল তুখোড়। তার পরও ধর্মগর্বী মৌলবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলে আজ ইসরায়েল চালাচ্ছে।
চলতি গাজা যুদ্ধের সময় এক ইসরায়েলি কমান্ডার সেনাদের একটা নির্দেশ দেন, তা অনেককেই সচকিত করেছে। তিনি তাঁর অফিসারদের ‘ইসরায়েলের ঈশ্বরের’ নামে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছেন। তাঁর কাছে এটা ধর্মযুদ্ধ, আর কিছু নয়। সরকারিভাবে এই যুদ্ধে ইসরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য হলো সীমান্ত রক্ষা এবং হামাসের রকেট ছোড়া বন্ধ করা। কিন্তু ওই কর্নেলের লক্ষ্য সেটা নয়। তিনি তাঁর সেনাদের জীবন দিতে বলেছেন ইসরায়েলের ঈশ্বরের সম্মান রক্ষার জন্য।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখন কিপ্পাহ পরা (রক্ষণশীল ইহুদিদের মাথার খুলি–ঢাকা ছোট টুপি) গোঁড়া সৈন্যে ভরে গেছে। এরা সামরিক-ধর্মীয় বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত হয়ে বাকিদেরও তাদের পথে টেনে আনে। দুঃখের বিষয়, ওই কর্নেল নিন্দিত হওয়ার বদলে তুমুলভাবে নন্দিত হন।
ইহুদিবাদী-ধর্মীয় দল এবং এর মৌলবাদী পুরোহিতেরা, বহুদিন থেকেই সেনাবাহিনীর অফিসার সারিতে অনুপ্রবেশ চালিয়ে আসছে। যেসব অফিসার ফিলিস্তিনি ভূমিতে ঔপনিবেশিক দখলদারদের মতো চলতে রাজি নয়, তাদের এরা পাঠিয়ে দেয় হাই-টেক উদ্যোক্তা হতে; আর তাদের শূন্যস্থান পূরণ করে জঙ্গি মনোভাবের অফিসাররা।
এসব ঘটনায় আমার নজর আইসিসের দিকে চলে যায়। সম্প্রতি এর নাম বদলে সাদামাটাভাবে ইসলামিক স্টেট করা হয়েছে। এর অর্থ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের তৈরি করা মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র আর রইল না। তারা সেখানে একটি মাত্র ইসলামি রাষ্ট্র চায়, যার মধ্যে থাকবে সব আরব এলাকা ও ফিলিস্তিন (ইসরায়েলও অন্তর্ভুক্ত)।
এটা নতুন ভয়াবহ ঘটনা। মুসলিম দুনিয়ায় অনেক ইসলামি দল আছে—তুরস্কের শাসক দল, মিসরের ব্রাদারহুড ও ফিলিস্তিনের হামাস। এদের সংগ্রাম নিজ নিজ রাষ্ট্রের মধ্যেই সীমিত। ক্ষমতায় গিয়ে নিজ দেশ শাসন করাই তাদের লক্ষ্য। এমনকি ওসামা বিন লাদেনও চাইতেন তাঁর সৌদি মাতৃভূমির নিয়ন্ত্রণ।
আইসিস এদের মতো নয়। এরা পশ্চিমাদের তৈরি করা সব মুসলিম রাষ্ট্রের ধ্বংস চায়। ভয়ংকর বর্বরতাকে তারা ধর্মীয় উচ্চতায় তুলতে চায়, তারা চায় সমগ্র মুসলিম জাহানের দখল এবং তার পরে সমগ্র বিশ্ব।
মাত্র কয়েক হাজার যোদ্ধা নিয়ে এমন অভিলাষ উদ্ভট শোনালেও ইতিমধ্যে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ তাদের দখলে। হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার মুসলিম বাসনাকেও তারা উসকে দিয়েছে। নাৎসি আন্দোলনও ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছিল—সেই অসন্তোষ, সেই প্রতিশোেধর স্পৃহা এবং গরিব ও লাঞ্ছিতদের সেভাবেই দলে টানা। সব আরব রাষ্ট্রের হুমকি হয়ে উঠতে এদের হয়তো কয়েক বছর লাগবে। তারা ইসরায়েলকেও চ্যালেঞ্জ জানাবে। এর গতি বজায় থাকলে আসাদ সরকার অচিরেই উচ্ছেদ হবে এবং আইসিস পৌঁছে যাবে ইসরায়েলি সীমান্তে।
উত্তরে এ রকম বিপদ ঘনিয়ে আসার সময় গাজায় দেশপ্রেমিক-ইসলামি খুদে শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অর্থহীন। আরব জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে, বিশেষত ফিলিস্তিনের সঙ্গে—পিএলও ও হামাস উভয়ের সঙ্গেই— শান্তি কায়েমের জন্য ইসরায়েলের হাতে সময়ও খুব কম। কিন্তু এটা আমাদের করতেই হবে। কারণ, এর বিকল্প হবে আরও ভয়াবহ।
দি আউটলুক থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলের শান্তিবাদী আন্দোলন গুশ সালোমের নেতা, সাবেক সাংসদ এবং লেখক।