আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে উপস্থাপিত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় আলোচনা হওয়ার কথা। প্রস্তাবটির বিষয়বস্তু ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ গ্রুপ থেকে টেকসই উত্তরণে সহায়তা–সম্পর্কিত। ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত গ্রুপ থেকে বাংলাদেশের বেরিয়ে যাওয়ার কথা, ফলে এ বিষয়ে অন্য ১১টি দেশের মতো বাংলাদেশেরও বিশেষ আগ্রহ ও অংশগ্রহণ থাকবে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কোনো স্বল্পোন্নত দেশ যখন এই গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাবে, তার পরবর্তী ১২ বছর যেন সেই দেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সিদ্ধান্তের আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে প্রদত্ত বিভিন্ন সুবিধা অব্যাহতভাবে ভোগ করতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যদি ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরি থেকে বেরিয়ে যায়, যেসব সুবিধা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে পাচ্ছে (এবং এ অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আরও পেতে পারে) সেগুলো যেন ২০৩৬ সাল পর্যন্ত আমরা ধারাবাহিকভাবে ভোগ করতে পারি। যেমন শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজার-সুবিধা, ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে সুবিধা, সরবরাহ সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি খাতে প্রদত্ত সহায়তা ইত্যাদি।
এ প্রস্তাব গৃহীত হলে বর্তমানে যে ১২টি স্বল্পোন্নত দেশ, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যাদের উত্তরণ হওয়ার কথা, শুধু তারাই যে লাভবান হবে, তা নয়। পরবর্তী সময়েও যেসব স্বল্পোন্নত দেশ এ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাবে, তাদের জন্যও এই সুবিধাগুলো সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
বলা প্রয়োজন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবটি আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশ চাদ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় পেশ করেছে, সেটি প্রণয়নের পেছনে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃত্বমূলক ভূমিকা ছিল। ২০২১ সালের জুনে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দ্বাদশ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এ প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করার দাবি তোলা হয়েছে। এ প্রস্তাবের প্রতি স্বল্পোন্নত গ্রুপের সব দেশেরই জোরালো সমর্থন রয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর টেকসই উত্তরণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্রিয় সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে এর আগে একাধিক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার ‘অস্ত্র ছাড়া সবকিছু’ (Everyting But Arms) উদ্যোগের অধীনে স্বল্পোন্নত গ্রুপ থেকে উত্তরণের পরও এসব দেশকে অতিরিক্ত তিন বছর শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাজার-সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
উত্তরণের জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশকৃত হওয়ার জন্য কোনো স্বল্পোন্নত দেশকে পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় তিনটি সূচকের যেকোনো দুটিতে (অথবা আয় সূচকের দ্বিগুণ) সীমারেখা অতিক্রম করতে হয় এবং সে দেশের ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত সাপেক্ষে তা জাতিসংঘের সাধারণ সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর করা হয়। জাতিসংঘের ইকোসকের অধীন কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক বৈঠকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয় এবং কোনো স্বল্পোন্নত দেশকে উত্তরণের জন্য সুপারিশ করা হয়। সিডিপির পরবর্তী ত্রিবার্ষিক বৈঠক হবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
কোভিডের এ বছরেও স্বল্পোন্নত যেসব দেশ উত্তরণের জন্য বর্তমানে বিবেচিত হচ্ছে, তারা পর্যালোচনা পিছিয়ে দেওয়ার বা বিলম্বিত উত্তরণের দাবি তোলেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
কোভিডের অভিঘাতে বর্তমানে উত্তরণে তালিকাভুক্ত দেশগুলোর চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। এসব দেশকে স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হচ্ছে; তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচের জনসংখ্যা ও বেকারত্ব বেড়েছে; অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রপ্তানি কার্যক্রমে নতুন নতুন ঝুঁকি যোগ হয়েছে। সংখ্যার বিচারে ২০২১-এর পর্যালোচনায় অবশ্য এসব ক্ষত ও ক্ষয়ক্ষতি ধরা পড়বে না, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যে তিনটি সূচক আছে, তার হিসাব করা হবে কোভিডের আগের তিন বছরের গড়ের নিরিখে। আর এটাও জানা কথা যে স্বল্পোন্নত দেশের কাঠামোগত দুর্বলতা, প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ, অবকাঠামোর অবস্থা ও প্রতিযোগিতা-সক্ষমতার দুর্বলতার বিষয়গুলো উত্তরণের তিনটি মাপকাঠি দ্বারা যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় না, ধরা পড়ে না। স্বল্পোন্নত পর্যায় থেকে উত্তরণ হলেই এসব দুর্বলতা কেটে যাবে ও অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের সুবাদে উত্তরণ টেকসই হবে, এমন ধারণা করার বাস্তব ভিত্তি নেই। স্মরণযোগ্য, যে পাঁচটি স্বল্পোন্নত দেশ এর আগে স্বল্পোন্নত ক্যাটাগরি গ্রুপ থেকে বেরিয়েছে, তারা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এ প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করেছে; উত্তরণ প্রক্রিয়ার নির্ধারিত ছয় বছরের স্থানে তারা গড়ে সময় নিয়েছে আরও বেশি। যে ১২টি স্বল্পোন্নত দেশ উত্তরণ পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোর মধ্যেও বেশ কয়েকটি দেশ এর আগে সময় বৃদ্ধির অনুরোধ করেছে ও নির্ধারিত ছয় বছরের বেশি সময় নিয়ে এ গ্রুপ থেকে বের হতে যাচ্ছে। এসব কারণেই জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এসব দেশের টেকসই উত্তরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে এবং তার সমর্থনে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
লক্ষণীয়, কোভিডের এ বছরেও স্বল্পোন্নত যেসব দেশ উত্তরণের জন্য বর্তমানে বিবেচিত হচ্ছে, তারা পর্যালোচনা পিছিয়ে দেওয়ার বা বিলম্বিত উত্তরণের দাবি তোলেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সিপিডিসহ বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের বাইরের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উত্তরণের জন্য চিহ্নিত ১২টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব হবে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রধানত যেসব দেশে রপ্তানি করে, সেসব দেশে শুল্ক বৃদ্ধি পাবে গড়ে প্রায় ৯ শতাংশ। এর ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তার কারণে আমাদের বৈশ্বিক রপ্তানির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে ১৪ শতাংশ। ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে পেটেন্ট-লাইসেন্সের ক্ষেত্রে যে সুবিধা বাংলাদেশ বর্তমানে ভোগ করে ও যার সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশ খুব ভালোভাবে সক্ষম হয়েছে, সে সুবিধাও পরবর্তী সময়ে থাকবে না। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার ধারাবাহিক আর্থসামাজিক সাফল্যের ও বিভিন্নমুখী অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করেছে এবং ২০২৪ সালে নির্ধারিত ছয় বছরের মধ্যেই স্বল্পোন্নত গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোভিডের চ্যালেঞ্জের এ বছরেই।
স্মর্তব্য যে, ২০১১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য সংঘটিত চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলনে পরবর্তী এক দশক এসব দেশকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তার অধিকাংশই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এ সম্মেলনেই ২০২০ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নিজস্ব প্রচেষ্টায় এবং উত্তরণ সূচকগুলোর তিনটির মধ্যে দুটির মান ২০১২ সালের স্তরে স্থির রাখার সিদ্ধান্তের বদৌলতে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃশ্যমান অগ্রগতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সম্মেলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যেমন বিশ্ববাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর রপ্তানি অংশ দ্বিগুণ করার জন্য (১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ) উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার, সেসবের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদ্যোগ ও অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক।
এর বিপরীতে উত্তরণমুখী স্বল্পোন্নত দেশগুলো বলছে, তারা উত্তরণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কোভিডের এ বছরেও তারা এ প্রতিজ্ঞা থেকে সরে না আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
উত্তরণ পর্যায়ের স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বাজার-সুবিধা ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান অতিরিক্ত কয়েক বছরের জন্য অব্যাহত রাখলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য স্বার্থের উল্লেখযোগ্য বিরূপ প্রভাব পড়বে না। পণ্য ও সেবা খাতের বিশ্ববাজারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অংশ নগণ্য; তারা এসব দেশের জন্য কোনো হুমকি নয়। বরং দেখা যাচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশগুলো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অধিকতর পরিমাণে আমদানি করার সক্ষমতা অর্জন করছে এবং এসব দেশ থেকে তাদের আমদানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং উত্তরণকালীন এসব দেশকে বাড়তি আরও কয়েক বছরের জন্য বাজার-সুবিধাসহ অন্যান্য সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করার মধ্যে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নিজস্ব স্বার্থের বিষয়টিও উপেক্ষণীয় নয়।
স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও উত্তরণকালীন অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশ যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ দেখিয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অনুষ্ঠিতব্য আলোচনায় উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো তার প্রতি কতটা সম্মান ও সহানুভূতি দেখাতে প্রস্তুত, তা জানার জন্য আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।
● মোস্তাফিজুর রহমান সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)