মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র নেই। কিন্তু তারপরও প্রতি চার বছর পরপর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাগ্যও পরিবর্তিত হয়। ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পরও তাই প্রশ্ন উঠছে, তার এ বিজয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য কতটুকু পরিবর্তিত হবে?
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বাইডেন বলেছেন, তিনি ইরানকে পুনরায় পারমাণবিক চুক্তির আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় করা পারমাণবিক চুক্তিটিকে (জেসিপিওএ) ডেমোক্র্যাট পার্টি তাদের অন্যতম অর্জন হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ২০১৮ সালে সেই চুক্তি বাতিল করেন। তাঁর এই পদক্ষেপের ফলে ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে।
ওবামার পথ ধরে জো বাইডেন তাই আন্তরিকভাবেই ইরানের সঙ্গে চলমান এই উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ হবে না। একবার চুক্তি ভঙ্গ করায় ইরানিরা এবার সহজে আমেরিকার মিষ্টি কথায় ভুলবে না। তারা আগের চেয়েও কঠিন ছাড় দাবি করে বসবে, যা দেওয়া হয়তো বাইডেনের পক্ষে সম্ভব হবে না। তা ছাড়া ইরানের আগামী নির্বাচনে যদি রক্ষণশীলেরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে, যেহেতু তাদের অনেকে প্রথমবারই পারমাণবিক চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বাইডেনের এই প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট করবে সৌদি আরবকে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময় তাঁর জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে সৌদি আরব তাদের প্রতিটি অন্যায় পদক্ষেপে যে রকম আমেরিকার সমর্থন পেয়ে আসছিল, বাইডেনের আমলে তা ঘটবে না। বাইডেন অবশ্যই ক্ষমতায় এসেই সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে তুলে এনে প্রিন্স মোহাম্মদকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি তুলবেন না, কিন্তু তাঁর শাসনামলে যদি সৌদি আরব পুনরায় এ রকম কোনো ঘটনা ঘটায়, তাহলে তিনি আর কিছু না হলেও শক্ত অবরোধ আরোপ করতে বাধ্য হবেন।
বাইডেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে তিনি ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন বন্ধ করবেন এবং সৌদি আরবের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু বাইডেনের অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তাঁর এই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। ওবামার শাসনামলের শেষের দিকে সম্পর্কের অবনতির মধ্য দিয়েও বাইডেন সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যেই অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে ইয়েমেনের ওপর বিমান হামলা করার কাজেই।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের ক্ষেত্রে বাইডেন ছিলেন ট্রাম্পের নীতির প্রচণ্ড সমালোচক। কিন্তু বাস্তবে তিনি নিজেও এমন কিছুই করবেন না, যা ইসরায়েলের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। নিজেকে বাইডেন একজন খ্রিষ্টান জায়নবাদী হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায়, তিনি ট্রাম্পের বিপরীতে গিয়ে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেম থেকে সরিয়ে পুনরায় তেল আবিবে নিয়ে আসবেন না। এবং অতীতের মতোই ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রাখলেও তিনি তাতে কোনো বাধা দেবেন না কিংবা ইসরায়েলের প্রতি সামরিক সাহায্য হ্রাস করবেন না।
কিন্তু ট্রাম্প যে রকম দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিলেন, গোলান মালভূমি, জর্ডান উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের ৩০ শতাংশ ভূমি ইসরায়েলের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার ইসরায়েলি পরিকল্পনাকে সমর্থন দিয়েছিলেন, বাইডেন খুব সম্ভবত সেগুলোর বিরোধিতা করবেন। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে রকম ফিলিস্তিনিদের প্রতি বার্ষিক ৬০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের অফিস বন্ধ করে দিয়েছিলেন, বাইডেন খুব সম্ভবত সেগুলো পুনরায় চালু করবেন। তাঁর এসব উদ্যোগের ফলে দীর্ঘমেয়াদি ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো সমাধান না হলেও আপাতত ফিলিস্তিনি জনগণ কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
ইরাক ও আফগানিস্তানের ব্যাপারে বাইডেনের অবস্থান হবে কিছুটা বাস্তববাদী। ট্রাম্প সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বললেও বাস্তবসম্মত কারণেই শেষ পর্যন্ত তা পারেননি। অন্যদিকে বাইডেন কখনোই সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার পক্ষে নন। মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে তিনি ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সংকট সৃষ্টি না হলে নতুন করে বাড়তি সেনাবাহিনী সেখানে পাঠাতে তিনি রাজি হবেন না।
আফগানিস্তান থেকেও বাইডেন সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করতে রাজি হবেন না। কিন্তু ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন জেনারেলদের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অপারেশন জোরদার করার পরিকল্পনার বিরোধিতার ইতিহাস তাঁর আছে। তা ছাড়া ওবামার সময় তিনিও গোপনে তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিলেন। কাজেই ট্রাম্পের সঙ্গে শুরু হওয়া তালেবানের শান্তি আলোচনা থেকে তিনি হয়তো পুরোপুরি বেরিয়ে আসবেন না।
সিরিয়া নিয়ে দুই প্রেসিডেন্টের নীতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না। বাইডেনও সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখবেন। কিন্তু পার্থক্য হবে, তিনি হয়তো পুনরায় কুর্দিদের প্রতি সহায়তা বৃদ্ধি করবেন। তুরস্কের ব্যাপারেও বাইডেনের নীতি হবে বিরোধী দলগুলোর প্রতি সমর্থন বৃদ্ধির
এবারের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে সিরিয়া প্রসঙ্গ প্রায় ছিল না বললেই চলে। সেখান থেকে ধারণা করা যায়, সিরিয়া নিয়ে দুই প্রেসিডেন্টের নীতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না। বাইডেনও সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখবেন। কিন্তু পার্থক্য হবে, তিনি হয়তো পুনরায় কুর্দিদের প্রতি সহায়তা বৃদ্ধি করবেন।
তুরস্কের ব্যাপারেও বাইডেনের নীতি হবে বিরোধী দলগুলোর প্রতি সমর্থন বৃদ্ধির। বাইডেন পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, তিনি চান বিরোধী দলগুলোকে সাহায্য করার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল ক্রয় করা নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে তুরস্কের আগে থেকেই দ্বন্দ্ব চলছিল। তা ছাড়া তুরস্ক যেভাবে আশপাশের বিভিন্ন দেশে নিজের প্রভাব বিস্তার করে চলছে, সেটাও আমেরিকা ও ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগের কারণ। এত দিন পর্যন্ত কেবল এরদোয়ানের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারণেই কংগ্রেস এ ব্যাপারে কিছু করতে পারেনি।
বাইডেন যা করতে পারেন তা হচ্ছে, তুরস্কের ওপর বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ করে তুরস্কের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তোলা এবং সেই সঙ্গে আশা করা যে তুরস্কের জনগণ একসময় রাস্তায় নেমে এসে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করবে।
মিসর ও লিবিয়ার ব্যাপারে বাইডেনের সঙ্গে ট্রাম্পের নীতির খুব বেশি পার্থক্য থাকবে না। ২০১১ সালে ওবামা প্রশাসন গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও বাইডেন নিজে তার বিরোধিতা করেছিলেন। এবং পরবর্তীকালে আমেরিকা লিবিয়া থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়েও নিয়েছিল। এখনো বাইডেন সম্ভবত সেই একই নীতি অনুসরণ করবেন। তিনি জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারের প্রতিই সমর্থন ব্যক্ত করবেন এবং সম্ভবত জাতিসংঘের মিশনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করবেন।
মিসরে যদিও প্রেসিডেন্ট সিসিকে ট্রাম্প তাঁর ‘ফেবারিট ডিক্টেটর’ বলে মন্তব্য করায় বাইডেন প্রচণ্ড সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে বাইডেন নিজেও সিসির বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না। মিসরসহ অধিকাংশ একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বাইডেনের অবস্থান হবে মুখে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে গণমাধ্যমের সামনে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক রাখা এবং সেই সঙ্গে কিছু অ্যাকটিভিস্টকে জেল কিংবা মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এর বাইরে তাঁর আমলেও জনস্বার্থবিরোধী একনায়কেরা আগের মতোই বহাল তবিয়তে টিকে থাকবেন।
এর বাইরে বাইডেনের শাসনামলে যদি দ্বিতীয় আরব বসন্ত সৃষ্টি হয়, তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবেই তাতে ট্রাম্পের তুলনায় অনেক বেশি সমর্থন দেবেন, একই সঙ্গে তাঁর সমর্থন হবে ওবামার তুলনায় অনেক কম। মধ্যপ্রাচ্য এখন আর আমেরিকার জন্য ২০১১ সালের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাইডেনের এখন প্রথম অগ্রাধিকার হবে করোনাভাইরাস এবং অভ্যন্তরীণ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও মধ্যপ্রাচ্যের স্থান হবে ইউরোপের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে নিজের উপস্থিতি জোরদার করার পরে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাইডেন ওবামার মতো অতিরিক্ত গণতন্ত্রায়ণও চাইবেন না, আবার ট্রাম্পের মতো একনায়কদের অতিরিক্ত ছাড়ও দেবেন না। তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহারও করে নিতে চাইবেন না, আবার নতুন সৈন্য পাঠিয়ে নতুন যুদ্ধে জড়াতেও চাইবেন না। ইসরায়েলকে তিনি ট্রাম্পের মতো পুরোপুরি ছাড়ও দেবেন না, আবার ওবামার আমলের শেষের দিকের মতো ইসরায়েলি অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের বিল পাস করতেও সাহায্য করবেন না। যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটে, তাহলে বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্যনীতি হবে ওবামা ও ট্রাম্পের মাঝামাঝি।
মোজাম্মেল হোসেন বেনগাজি, লিবিয়া থেকে