বাংলাদেশে অবস্থাটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনাকে বাঙালি হতে হবে! আপনি যদি বাঙালির ঘরে জন্ম না নিয়ে সাঁওতাল, ওঁরাও, চাকমা, মারমা কিংবা আমরা যাঁদের আটকে পড়া পাকিস্তানি বলি, বিহারি বলি, যাঁরা আসলে ১৯৪৭-এর পরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, বিশেষ করে বিহার থেকে পূর্ব বাংলায় এসেছিলেন, সেই ‘বিহারিদের’ ঘরে জন্ম নেন, তাহলে হবে না। এই লেখাটা এমন এক দিনে লিখছি, যখন জাতীয় সংসদে বৈষম্যবিরোধী আইনের খসড়া পেশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ভাষা, বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক, মানসিক বা তৃতীয় লিঙ্গ, জন্মস্থান, জন্ম, পেশা ও অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কিছু কাজ করলে তা বৈষম্যমূলক কাজ বলে গণ্য হবে।’
৬ এপ্রিল প্রথম আলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানের একটা সাক্ষাৎকার ছেপেছে এই বিষয়কে নিয়ে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘বৈষম্যকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য না করা আইনের দুর্বল দিক।’ এই সাক্ষাৎকারের নিচে মন্তব্যের ঘরের একটা মন্তব্যের প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি, ‘আমি জাতিতে চাকমা, কিন্তু আমার পরিচয়কে জোরপূর্বক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বানিয়েছে সরকার। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বড় নৃগোষ্ঠী—এ ধরনের পরিচয়বৈষম্য বর্তমান সরকারই সৃষ্টি করেছে। আগে আমি নামের আগে বাবু কিরণ চাকমা লিখতাম অফিসে, কিন্তু সরকার আমাকে জনাব কিরণ চাকমা লিখতে বাধ্য করাচ্ছে। ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের স্বাধীন আত্মপরিচয়দানের যে অধিকার, এটা আমার দেশে নেই। জাতিতে বড় হলে, ক্ষমতাই বড় হলে তবেই সব অধিকার পায়, ছোট জাতি-ক্ষমতাহীন হলে তার অধিকার নেই নিজের সঠিক আত্মপরিচয় দেওয়ার। রাষ্ট্রই অনেক বৈষম্যের জন্য দায়ী। এ বৈষম্যগুলো কিছু জাতিগত, কিছু ধর্মীয়।’
একই সময়ে আমরা জানি, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর নিমঘটু গ্রামে দুজন সাঁওতাল কৃষক ধানখেতে সেচের পানি চেয়েছিলেন, পানি বিতরণব্যবস্থায় ত্রুটি পেয়েছে পরে এ-সংক্রান্ত গঠিত তদন্ত কমিটি, তাঁরা পানি পাননি বলে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার খবরকে মহিমান্বিত করতে হয় না; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন আমি নিজে দুবার অনুবাদ করে প্রথম আলোয় প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের সমতলের জনজাতি বা নৃগোষ্ঠী বা আদিবাসীরা যে নানা বৈষম্যের শিকার, এই কথা আমরা অনেকেই জানি। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালসহ কৃষকেরা কৃষিজমিতে ইপিজেড করার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন।
আবার শুধু বাঙালি হলে সুবিধা হবে না, বাঙালি মুসলমান হতে হবে। বাঙালি মুসলমান শব্দজোড়টি জনপ্রিয় করেছিলেন আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন নামের বই লিখে। ২০২২ সালে প্রকাশিত মোহাম্মদ আজমের সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ বইটিতে লেখক আহমদ ছফার ওই প্রবন্ধের সমালোচনা করেছেন (প্রকাশক সংহতি)। আজমের প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস প্রণয়নের সংকট’। এই ধরনের গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা যেমন এই লেখকের নেই, এই কলাম সে রকম আলোচনার জায়গাও নয়। আমি শুধু দেখছি, এই দেশে আপনাকে যদি টিকতে হয়, শান্তিতে ও স্বস্তিতে থাকতে হয়, তাহলে বাঙালি হতে হবে, বিহারি-সাঁওতাল-চাকমা হলে চলবে না। আবার শুধু বাঙালি হলে চলবে না। মুসলমানও হতে হবে।
মুন্সিগঞ্জে ঘটে গেছে এক উদ্বেগজনক ঘটনা। হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক। ইসলাম ধর্মকে অবমাননার অভিযোগে গত ২২ মার্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ বাদী হয়ে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। ওই দিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর নিজের শ্রেণিকক্ষের ছেলেরা বিজ্ঞানের ক্লাসে নানা রকমের প্রশ্ন করে, ধর্মই সকল বিজ্ঞানের মূল আকর বলে দাবি করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল খুব ঠান্ডা মাথায় শিক্ষার্থীদের বিষয়টা বোঝাচ্ছিলেন; তিনি কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি, ধর্ম ও বিজ্ঞান বিষয় দুটোর উপজীব্য কী, তা বোঝাচ্ছিলেন; শিক্ষার্থীরা সেই কথোপকথন ভিডিও করেছে, তা ছড়িয়ে দিয়েছে ইন্টারনেটে; স্কুল কর্তৃপক্ষই মামলা করেছে; এবং বিস্ময়কর কিংবা বিস্ময়েরই-বা কী আছে যে এই বিজ্ঞানশিক্ষককে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে লতা সমাদ্দার কেন কপালে টিপ পরেছেন, এই নিয়ে এক পুলিশ সদস্যের অবমাননাকর আচরণ নিয়ে যে তোলপাড় উঠেছিল, তা এখনো নিস্তরঙ্গ হয়নি। ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁরা এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন; হৃদয় মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছেন; আর বলেছেন, ‘যে কিশোর ছাত্ররা মৌলবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে অপমান করে পুলিশে সোপর্দ করেছে, তাদের মধ্যে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের যেসব ব্যক্তি এহেন কাজে সহযোগিতা ও ইন্ধন জোগাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’
বলছি, এ দেশে শুধু বাঙালি হলে চলবে না, মুসলমান হতে হবে। শুধু মুসলমান হলে চলবে না, বাঙালি হতে হবে। এবং শুধু বাঙালি মুসলমান হলে চলবে না, বাঙালি মুসলমান পুরুষ হতে হবে। শুধু বাঙালি মুসলমান পুরুষ হলে হবে না; বাঙালি মুসলমান পুরুষদের মধ্যেও অচ্ছুত গোত্র আছে; বাঙালি মুসলমান পুরুষ উচ্চবংশীয়, টাকাওয়ালা এবং ক্ষমতাবর্গীয় হতে হবে।
একটা রাষ্ট্র শুধু একটা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী দিয়ে গড়ে ওঠে না, নানা নৃগোষ্ঠী তাতে থাকে; একটা ধর্মের লোক দিয়ে একটা দেশ হয় না, বিভিন্ন ধর্মের, বর্ণের, শ্রেণির, পেশার মানুষ তাতে থাকবে এবং প্রতিটা মানুষ সমান। সমান তাদের মর্যাদা। সমান তাদের অধিকার। একজনও যদি ভিন্নমতের হয়, ভিন্ন বর্ণের হয়, ভিন্ন ধর্মের হয়, ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের হয়, তার প্রতি রাষ্ট্র কী রকমের আচরণ করছে, তা দিয়েই বোঝা যাবে, সেই রাষ্ট্র উন্নত কি উন্নত নয়।
‘বাঙালি মুসলমান’ কথাটা এখন একাডেমিক আলোচনায় খুব শুনতে পাই। কেউ কেউ বলেন, বাঙালি মুসলমানদের যে অংশটুকু মুসলিম লীগ করত, তাঁরাই তাঁদের শ্রেণিস্বার্থে পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে বাঙালি মুসলমানদের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলন করেছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন। কথাটার মধ্যে সম্পূর্ণ সত্যতা নেই। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ ইতিহাসের যেসব বইয়ে ১৯৪৭-৪৮ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সূচনার বিবরণ পাই, তা থেকে জানতে পারি, শেখ মুজিব ঢাকায় এসে প্রথমে অসাম্প্রদায়িকতাবাদী আন্দোলন শুরু করার পক্ষে মত দেন এবং কাজ করতে শুরু করেন।
আমরা জানি, পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি উত্থাপন করেন। ভাষা আন্দোলনে বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই অংশ নিয়েছিল, যেমন মুক্তিসংগ্রামে ও যুদ্ধে বাঙালি-অবাঙালি-নানা জাতিগোষ্ঠী নারী-পুরুষ হিন্দু-মুসলিম অংশ নিয়েছিল।
তবে এ–ও সত্য যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদী জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলাম। আমাদের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ চার মূলনীতির একটা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে যখন পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী সামনে নেই, তখন জাতীয়তাবাদী জোয়ারের রাশ টেনে ধরতে পারতে হবে। বঙ্গবন্ধু কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
একটা রাষ্ট্র শুধু একটা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী দিয়ে গড়ে ওঠে না, নানা নৃগোষ্ঠী তাতে থাকে; একটা ধর্মের লোক দিয়ে একটা দেশ হয় না, বিভিন্ন ধর্মের, বর্ণের, শ্রেণির, পেশার মানুষ তাতে থাকবে এবং প্রতিটা মানুষ সমান। সমান তাদের মর্যাদা। সমান তাদের অধিকার। একজনও যদি ভিন্নমতের হয়, ভিন্ন বর্ণের হয়, ভিন্ন ধর্মের হয়, ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের হয়, তার প্রতি রাষ্ট্র কী রকমের আচরণ করছে, তা দিয়েই বোঝা যাবে, সেই রাষ্ট্র উন্নত কি উন্নত নয়। শুধু মাথাপিছু আয়ের হিসাব দিয়ে উন্নতির হিসাব করা যাবে না। লেখার শুরুতে মন্তব্য-লেখকের উদ্ধৃতিতে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার’ ক্ষুদ্র বিশেষণটা নিয়ে যে আপত্তি, তা আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একটা পরিভাষা দিয়েছিলেন, জনজাতি—জনগোষ্ঠীর বদলে জনজাতি। আমরা এই শব্দটা, অংশীজনের আপত্তি না থাকলে, বিবেচনায় নিতে পারি।
পয়লা বৈশাখ সামনে রেখে কি আমরা এই আওয়াজ তুলতে পারি, সিরাজউদ্দৌলা নাটকের সেই সংলাপের মতো, ‘বাংলাদেশ শুধু বাঙালির নয়, বাংলাদেশ সাঁওতাল, ওঁরাও, চাকমা, মারমা, বিহারিদেরও। বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাংলা শুধু মুসলমানের নয়, মিলিত হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও মতাবলম্বীরও জন্মভূমি-মাতৃভূমি দেশ ও রাষ্ট্র এই বাংলাদেশ।’
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক